অভিভাবক ছাড়া কাজি অফিসের বিবাহ

বিবাহের জন্য অভিভাবক শর্ত কি না; এ সম্পর্কে চার মাযহাবের ফুকাহায়ে কেরামদের মধ্যে বিস্তর মতবিরোধ রয়েছে। বিশেষ করে মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে। ছেলের এক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতি নেয়া জরুরি নয়। ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম হাম্বেলী এবং ইমাম আহমেদসহ জমহুর ওলামায়ে কেরামতের মতে অভিভাবক ব্যতীত বিয়ে শুদ্ধ হবে না। পক্ষান্তরে, হানাফি মাযহাব মতে বালেগা কুমারী-অকুমারী মেয়েদের বিবাহ তাদের অভিভাবকের সম্মতি ব্যতিরেকে হয়ে যাবে এবং অভিভাবকগণ নাবালক-নাবালিকার বিয়ে তাদের সম্মতি ব্যতীতও দিতে পারবে। তবে ঐ নাবালক-নাবালিকা অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত কোথাও বিয়ে বসতে পারবে না এবং বিয়ে করলেও সেটা বাতিল বলে গণ্য হবে।কেননা নাবালক থাকার ধরুণ শরীয়ত তাদের কাজকে সমর্থন দিবে না। হানাফি মাযহাবের মতে, বালেগা মেয়ের অভিভাবক যদি অসম্মত হয় এবং সে ছেলের তুলনায় শরীয়ত স্বীকৃত কুফু তথা বৈবাহিক সমতার ক্ষেত্রে উচ্চ মর্গিয়া বলে বিবেচিত হয় তাহলে এ বিবাহ শরীয়তসিদ্ধ হবে না। তবে যদি উভয়ের কুফু তথা বৈবাহিক সমতা ঠিক থাকে তাহলে মেয়ের অভিভাবকের অসম্মতিতেও বিবাহ শুদ্ধ হয়ে যাবে।


নিচে পাঠকের সুবিধার্থে কিছু সহীহ হাদিসের অবতারণা করা হল, যাবে পাঠকগণ বুঝে নিতে পারেন সঠিক মত কোনটি:

ইবনু আবূ উমর (রহঃ) সুফিয়ান (রহঃ) থেকে এই সূত্রে অনুরুপ বর্ণিত হয়েছে। এই সুত্রে আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পুর্ব বিবাহিত তার নিজের (বিবাহের) ব্যাপারে তার অতিভাবকের তুলনায় অধিক কতৃঁত্ব সম্পন্ন এবং পিতা কুমারী কন্যার নিজের ব্যাপারে তার সম্মতি নিবে। নীরবতাই তার সম্মতি। কখনও তিনি বলেছেনঃ তার নীরবতাই তার সম্মতি। [সহীহ বুখারী-৪৭৬০, ৪৭৬১, মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং-৮৮৮, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৩৩৪৫, ৩৩৪৪, ৩৩৪৬, ৩৩৪৭ ই.ফা]

কুতায়বা (রহঃ) ..... ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অকুমারী মেয়ে নিজের ব্যপারে তার ওলীর অপেক্ষা অধিক হকদার। কুমারীর বেলায় তার বিষয়ে তার নিকট থেকে অনুমতি নিতে হবে। আর তার চুপ থাকা অনুমতি। [তিরমিজি-১১০৮, মান হাসান-সহীহ] এই হাদিসগুলো থেকে বুঝা যায়, অকুমারী মেয়েদের বিবাহে তাদের অভিভাবকের অনুমতির দরকার নেই। পিতামাতা যদি কুমারি মেয়ের বিবাহ ঠিক করে তবে তাকে মেয়ের সম্মতি নিতে হবে।
হযরত ইবনে আব্বাস রাঃ থেকে বর্ণিত। এক কুমারী মেয়ে রাসূল সাঃ এর কাছে এসে বলল, আমার পিতা আমার অপছন্দ সত্বেও বিয়ে দিয়েছে, তখন রাসূল সাঃ সে মেয়েকে অধিকার দিলেন, [যাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারে বা এ বিয়ে রাখতেও পারে]। [মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-২৪৬৫, আবু দাউদ-২০৯৬, সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৮৭৫, হাদিসগুলির মান সহীহ] এই হাদিস থেকে বুঝা যায় একটা বিবাহ শুদ্ধভাবে হওয়ার জন্য অভিভাবক এবং মেয়ে উভয়েরই সম্মতি দরকার।

“আয়িশাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে নারীকে তার অভিভাবক বিবাহ দেয়নি তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল। স্বামী তার সাথে সহবাস করলে তাতে সে মাহরের অধিকারী হবে। তাদের মধ্যে মতবিরোধ হলে সে ক্ষেত্রে যার অভিভাবক নাই, শাসক তার অভিভাবক।“ [ইবনে মাজাহ-১৮৭৯, মান সহীহ, আবু দাউদ-২০৮৩, মান সহীহ, তিরমিজি-১১০২, মান হাসান] যদিও হাদিসটির ব্যাপারে ইমাম বুখারী রাহ. ও ইমাম তাহাবী রাহ. আপত্তি করেছেন।
এ হাদীস দ্বারাই বুঝা যাচ্ছে যে, এখানে বিবাহ বাতিল হয়ে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়। কারণ হাদীসের শেষাংশে বলা হচ্ছে, স্ত্রী মহরের অধিকারী হবে। যদি বিবাহ শুদ্ধই না হতো, তাহলে মোহর আবশ্যক হওয়ার কথা আসছে কেন? মোহরতো বিবাহের মাধ্যমে আবশ্যক হয়। বিবাহ ছাড়া আর্থিক জরিমানার জন্য ব্যবহৃত হয় আরবী عقراশব্দ ব্যবহৃত হয়। অথচ এখানে ব্যবহৃত করা হয়েছে। মোহর শব্দ। যা বিবাহের সাথে খাস। সুতরাং বুঝা যাচ্ছে এখানে আসলেই বিবাহ বাতিল হয়ে যায়, এটি উদ্দেশ্য নয়। বরং ধমকী দেয়া উদ্দেশ্য। যেন অভিভাবকদের না জানিয়ে মেয়েরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হয়। তবে অভিভাবকবিহীন বিবাহ বৈধ হলে ইসলামী শরীয়ত এ ধরনের বিবাহে নিরুৎসাহিত করে। মাতা পিতাকে কষ্ট দেয়া ইসলামী শরীয়তে বৈধ নয়। তাই বাবা মাকে না জানিয়ে তাদেরকে অসন্তুষ্ট করে বিবাহ করলে তা সম্পন্ন হলেও বিধিসম্মত হবে না। তাই যে করেই হোক মাতা পিতাকে সন্তুষ্ট করেই বিবাহ করা চাই। এক্ষেত্রে মাতা পিতাকেও ছেলে মেয়েদের চাহিদার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। আমাদের সমাজে অভিভাবকপক্ষ মেয়েদেরকে এক প্রকার জোর করেই বিবাহ দেন। মেয়ের সম্মতি অসম্মতির প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ করেন না। এ ধরনের বিবাহ বস্তুত শুদ্ধ হয় কি না তা বিবেচনার দাবি রাখে।

আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “কোন মহিলা অপর কোন মহিলাকে বিবাহ দিবে না এবং কোন মহিলা নিজেকেও বিবাহ দিবে না। কেননা যে নারী স্ব-উদ্যোগে বিবাহ করে সে যেনাকারিণী।'' [ইবনু মাজাহ্ -১৮৮২, আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন, তবে যেনার বাক্য ব্যতিত] এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায় বিয়ে শুদ্ধ এবং পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য বৈধ অভিভাবক দরকার।
আবূ মূসা আশ'আরী (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, রসূল (সাঃ) বলেছেন : ''অভিভাবক ছাড়া কোন বিয়েই হবে না''। [ইবনে মাজাহ-১৮৮১, আহমাদ-১৯২৪৭, আবু দাউদ-১৮১৮,২০৮৫, মান সহীহ] এ হাদিস দ্বারা বুঝা যায় বিয়ে শুদ্ধ এবং পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য বৈধ অভিভাবক অবশ্যই দরকার।

উপসংহার:
উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে, শরীয়তে বিবাহে মেয়েদের জন্য ওলী থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও বর্তমান সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৌদী আলেম শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আলমুনজিদ ওলী ছাড়া মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে বলেছেন, “এটি একটি ইজতিহাদি মাসআলা, ইমামগণ এক্ষেত্রে ইখতিলাফ করেছেন। সুতরাং যে সব দেশের মানুষেরা হানাফী মাজহাবের উপর নির্ভর করে , ওলী ছাড়া বিবাহকে বৈধ মনে করে এবং এভাবে তাদের বিয়ে হয় যেমন, ভারত, পাকিস্থান ইত্যদি, তাহলে তাদের বিবাহের স্মীকৃতি দেয়া হবে । বাতিল করতে বলা হবে না।“ সাধারণভাবে যৌবনের শুরুতে যুবক-যুবতী সহজেই বয়সের উন্মাদনায় বিভ্রান্ত হয় এবং নিজের চোখের ভাল লাগার উপর নির্ভর করেই সঙ্গী পছন্দ করে। বিবাহের ক্ষেত্রে চোখের পছন্দের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ জীবন ও আগত প্রজন্মের কল্যাণের কথাও চিন্তা করতে হবে। এজন্য ইসলামে বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর মতমতের সাথে অভিভাবকের মতামতেরও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সুতরাং মেয়েদের জন্য আবশ্যক হলো ওলীর অনুমতি নিয়ে বিবাহ করা। আর আমাদের উচিৎ বিবাহের সময় মানুষদের কে ওলীর অনুমতির বিষয়ে উৎসাহিত করা,ওলী ছাড়া বিয়ে করতে নিষেধ করা এবং ওলী থাকার কল্যান বর্ণনা করা। যারা ইতিমধ্যে ওলীর অনুমতি ছাড়া বিবাহ করেছে তাদের বিষয়ে কথা হলো যেহেতু তারা একটি ফিকহী মত গ্রহন করেছেন আর বিষয়টি ইজতিহাদী এবং ইখতিলাফী তাই তাদেরকে নতুন করে বিবাহ করতে হবে না। তবে এই ঘৃনিত কাজের জন্য তাদের লজ্জিত হওয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও এবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব-ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং বল তাদেরকে শিষ্ঠাচারপূর্ণ কথা।(সূরা:১৭/২৩)
আল্লাহ তায়ালা সবচেয়ে ভাল জানেন।
নাম

আর্টিকেল,25,ডাউনলোড,1,বুখারী,81,মাসায়ালা,16,মুসলিম,54,
ltr
item
সহী আকীদা: অভিভাবক ছাড়া কাজি অফিসের বিবাহ
অভিভাবক ছাড়া কাজি অফিসের বিবাহ
সহী আকীদা
https://soheeaqida.blogspot.com/2021/08/marriage.html
https://soheeaqida.blogspot.com/
http://soheeaqida.blogspot.com/
http://soheeaqida.blogspot.com/2021/08/marriage.html
true
2725583972515071055
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy