রাসূল (স) এর মক্কী জীবন

মুহাম্মদ (সা.) জীবনের এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নিজেকে উজাড় করে দিয়েও সমাজে পরিপূর্ণভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেননি। অথচ তাঁর জীবনের কোন অংশেই ব্যর্থতা ছিলনা। অবশেষে তিনি তাঁর সমাজের নৈতিক ও ধর্মীয় অধ:পতন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়লেন। তিনি ভাবতে লাগলেন: তাঁর বংশের লোকেরা কিভাবে হাতে-গড়া মূর্তিকে নিজেদের মা’বুদ বা উপাস্য বানিয়েছে! নৈতিক দিক থেকে তারা কতো অধ:পতনে গিয়ে পৌঁছেছে। তাদের এ সব ভ্রান্তি কি করে দূরীভূত হবে? আল্লাহর নির্ভুল পথ কিভাবে তাদের দেখানো যাবে? এ বিশ্বজাহানের প্রকৃত স্র্রষ্টা ও মালিকের ইবাদত কিভাবে করা উচিত? এমনি অসংখ্য রকমের চিন্তা ও প্রশ্ন তাঁর মনের ভেতর তোলপাড় করতে লাগল। এসব বিষয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন।

নবুয়্যাত ও রেসালাতের সূচনা: মুহাম্মদ (সা.)-কে আল্লাহ পাক সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য করুণা স্বরূপ এবং গোটা মানবজাতির জন্য সুসংবাদ দাতা করে পাঠাবেন। ইতিপূর্বে পৃথিবীতে যত নবী রাসূল এসেছেন তাঁদের প্রত্যেকের নিকট থেকে আল্লাহ তা’আলা এ মর্মে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন যে, তাঁরা মুহাম্মদ (সা.) -এর ওপর ঈমান আনবেন, তাঁকে সমর্থন করবেন এবং তাঁর বিরোধীদের মুকাবিলায় তাঁকে সাহায্য করবেন। আর তাঁদের প্রতি যারা ঈমান আনবে ও সমর্থন জানাবে তাদেরকেও এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেবেন। সে অঙ্গীকার অনুসারে প্রত্যেক নবী নিজ নিজ অনুসারীদেরকে মুহাম্মদ (সা.) -কে মেনে নেয়া ও তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়ে যান।

আল্লাহ তা’আলা যখন মুহাম্মদ (সা.) -কে সম্মান ও মর্যাদায় ভূষিত করতে মনস্থ করলেন ও নবুয়্যাতের সূচনা করলেন, তখন তিনি কোন প্রয়োজনে বাইরে বেরুলে লোকালয় ছেড়ে অনেক দূরে মক্কার পার্বত্য উপত্যকায় ও সমভূমিতে চলে যেতেন। তখন যেকোন পাথর বা গাছের পাশ দিয়েই তিনি অতিক্রম করতেন ঐ পাথর বা গাছ বলে উঠতো, “হে আল্লাহর রাসূল! আপনার প্রতি সালাম।” এ কথা শোনা মাত্রই মুহাম্মদ (সা.) আশে পাশে ডানে বামে ও পেছনে ফিরে তাকাতেন। কিন্তু গাছ বা পাথর ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতেন না। আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা’আলা যখন মুহাম্মদ (সা.) -কে সম্মানিত করতে ও মানবজাতিকে তাঁর দ্বারা অনুগৃহীত করতে মনস্থ করলেন, তখন মুহাম্মদ (সা.) নবুয়্যাতের অংশ হিসেবে নির্ভুল স্বপ্ন দেখতে থাকেন। তিনি যে স্বপ্নই দেখতেন তা ভোরের সূর্যোদয়ের মতই বাস্তব হয়ে দেখা দিত। এ সময় আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নির্জনে অবস্থান করার প্রতি আগ্রহী করে দেন। একাকী নিভৃতে অবস্থান তাঁর কাছে সর্বাধিক পছন্দনীয় হয়ে ওঠে।

হেরা গুহায়: মক্কা-মুয়াজ্জমা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত জাবালুন নূর- ‘হেরা’ নামে একটি পর্বত। মুহাম্মদ (সা.) প্রায়ই সেখানে গিয়ে অবস্থান করতেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে চিন্তা-ভাবনা ও আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। সাধারণত খানা-পিনার দ্রব্যাদি তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন, শেষ হয়ে গেলে আবার নিয়ে আসতেন। কখনো কখনো খাদিজা (রাঃ) পৌঁছে দিতেন।
সর্ব প্রথম ওহী: এভাবে দীর্ঘ ছয়টি মাস কেটে গেল। মুহাম্মদ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করলেন। তিনি হেরা গুহায় যথারীতি আল্লাহর ধ্যানে মশগুল আছেন। সময়টি তখন রমযান মাসের শেষ দশক। সহসা তাঁর সামনে আল্লাহর প্রেরিত জিবরাইল ফেরেশ্তা এক খন্ড রেশমী কাপড় নিয়ে আভির্ভূত হলেন। ইনি ফেরেশতা-শ্রেষ্ঠ জিবরাইল (আঃ)। ইনিই যুগ-যুগ ধরে আল্লাহর রাসূলদের কাছে তাঁর বাণী নিয়ে আসতেন। ঐ রেশমী বস্ত্রখন্ডে কিছু লেখা ছিল। জিবরাইল আমাকে বললেন, “পড়”। আমি বললাম “আমি পড়তে জানি না।” তখন তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে এমনি জোরে চাপ দিলেন যে, আমি ভাবলাম মরে যাচ্ছি। অতঃপর মুহাম্মদ (সা.) -কে ছেড়ে দিয়ে আবার বললেন, “পড়”। কিন্তু তিনি আগের জবাবেরই পূণরুক্তি করলেন। জিবরাইল (আঃ) আবার তাঁকে আলিঙ্গন করে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, “পড়”। এবারও মুহাম্মদ (সা.) জবাব দিলেন, “আমি পড়তে জানি না।” পূণর্বার জিবরাইল (আঃ) মুহাম্মদ (সা.) -কে বুকে চেপে ধরলেন এবং ছেড়ে দিয়ে বললেন: “পড় তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট-বাঁধা রক্ত থেকে। পড় এবং তোমার প্রতিপালক অতীব সম্মানিত, যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে এমন জিনিস শিখিয়েছেন যা সে জানতো না।” (সূরা: আ’লাক ১-৫)। এই হচ্ছে সর্বপ্রথম ওহী। কত সুন্দর, কত মধুর! যুগ-যুগ ধরে যে-মহাসত্যের জন্য পৃথিবী প্রতীক্ষা করে আসছিল, বিশ্ব শান্তির জন্য সে বাণী অবতীর্ণ হতে শুরু করল। ওহীর প্রথম কথাই হল: পাঠ কর-অর্থাৎ জ্ঞান অর্জন কর। কুরআনের সর্বপ্রথম বিষয়বস্তুই হল “জ্ঞান”। জ্ঞানের প্রসঙ্গ নিয়ে সূচিত হল মুহাম্মদ (সা.) -এর নবুয়্যাতের জীবন, আর ইসলামের নতুন জয়যাত্রা। এ বিজ্ঞানের যুগে ইসলাম বিশ্বের সম্মুখে গর্ব করে বলতে পারে: জ্ঞান-সাধনাই হচ্ছে মুহাম্মদ (সা.) -এর প্রথম ও প্রধান পয়গাম। কী গভীর দার্শনিক তাৎপর্যই না নিহিত আছে এই প্রথম অবতীর্ণ ক্ষুদ্র আয়াত কয়টির মধ্যে।

এ আয়াত কয়টিতে তিনটি বিষয় আলোচিত হয়েছে: আল্লাহ, মানুষ ও জ্ঞান। প্রথমে আল্লাহর আত্মপরিচয় পেশ করা হয়েছে এ-ভাবে: তিনিই বিশ্বনিখিলের একমাত্র রব (প্রভু)। তিনিই সৃজনকারী, পালনকারী, যাবতীয় বিষয়ের পর্যবেক্ষণকারী ও ক্ষমতাশালী। তিনি একক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন অংশীদার নেই। এ ঘোষণার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের যাবতীয় ভ্রান্ত ধারণা যেমন, কারো ধারণা আল্লাহ বলতে কেউ নেই, পৃথিবী স্বয়ংসৃষ্ট, যা- কিছু হবার তা এমনিই হয় অথবা একাধিক ঈশ্বর ও দেবদেবীর দ্বারা বিশ্ব রচিত ও পরিচালিত-ইত্যাদি ধরনের যাবতীয় মতবাদকে আল্লাহ এখানে বাতিল করে দিয়েছেন এবং স্পষ্ট ঘোষণা করছেন যে, একমাত্র তিনিই ইহার স্রষ্টা ও নিয়ামক।
তারপর আসলো মানুষের পরিচয়। মানুষ কোথা হতে আসল? কে সৃষ্টি করল? সে পরিচয়ও আল্লাহ্ দিয়েছেন: মানুষকে তিনিই সৃষ্টি করেছেন সামান্য রক্ত কণিকা হতে। চিন্তার বিষয়, ক্ষুদ্র এক রক্তবিন্দুর মধ্যে আল্লাহ্ মানুষের সমস্ত শক্তি ও সম্ভাবনাকে গোপন রেখেছেন, তারপর ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে রক্তবিন্দুকে তিনি জ্ঞান, বিবেক সম্পন্ন শক্তিশালী মানুষে পরিণত করেছেন।

অবশেষে জ্ঞানের কথা; এটা কোথা থেকে আসল? এটাও আল্লাহ দান করেছেন। জ্ঞান অর্জনের দু’পদ্ধতি: ১. লিখনীলব্ধ (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য) জ্ঞান এবং ২. প্রত্যক্ষ জ্ঞান। জ্ঞান বিহীন মানুষ অন্ধের মত। আর অন্ধত্ব কখনো মানুষের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। রিসালাত মানুষের জীবন থেকে প্রথমে অন্ধত্ব দূর করে, এরপর তাকে আলোর সন্ধান দেয়। ফলে মানুষের ইহ ও পরকালীন কল্যাণের পথ সুগম হয়। প্রথম ওহী মানুষকে তিনটি কথা উপলদ্ধি করতে বলেছে। এ তিনটি সত্য বুঝতে পারলে মানুষ “সিরাতুল মুস্তাকীম” (সরল পথ) দিয়ে চলতে পারবে পথ ভ্রষ্ট হবে না। মানুষ যদি জানে এবং মানে যে, এ বিশ্ব নিখিলের সৃজনকারী, রক্ষাকারী ও ধ্বংসকারী একমাত্র আল্লাহ-তিনিই আমাদের জীবন মরণের প্রভু, তিনি ছাড়া আমাদের আর কোন উপাস্য নেই, উপায় নেই: তিনি আদি, তিনি অন্ত, তিনিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তবে কেমন করে সে আল্লাহকে ছেড়ে অপর কারো উপাসনা করবে? নতমস্তকে তাকে বলতেই হবে: প্রভু হে! একমাত্র তুমিই আমাদের ‘রব’ তুমি ছাড়া আমাদের আর কোন উপাস্য নেই, আমরা তোমারই ইবাদত করি, তোমারই কাছে সাহায্য চাই। এরপর নিজের দিকে খেয়াল করে সে যদি বুঝতে পারে যে, কত নি:সহায় অবস্থা হতে আল্লাহ্ তাকে জ্ঞান-বিবেক সম্পন্ন মানুষে পরিণত করেছেন, তাহলে আল্লাহর অসীম করুণা ও কুদরতের কথা ভেবে কৃতজ্ঞতায় তার মাথা সে ‘রবের’ উদ্দেশ্যে নত না হয়ে পারে না। আবার সে যদি বুঝতে পারে যে, আল্লাহই সকল জ্ঞানের উৎস এবং সে জ্ঞান অর্জন ছাড়া সৃষ্টিলীলার কোন রহস্যই সে বুঝতে পারবে না, তবে আল্লাহর নামে জ্ঞান সাধনায় প্রবৃত্ত হবেই। রাষ্ট্র , সমাজ ও জীবনে অন্যান্য সমস্যা এ তিনটি উপলব্ধি হতেই আসবে এবং তার চিন্তা ও কর্ম নতুন নতুন পথে প্রভাবিত হবেই। আল্লাহর সহিত জ্ঞানের সংযোগ সাধিত হলে সে জ্ঞান পূর্ণতা লাভ করবে এবং সে জ্ঞানই অশেষ কল্যাণের উৎস হবে।
রাসূল (সা.) বলেন, অতঃপর আমি শোনানো আয়াত কয়টি পড়লাম। এ পর্যন্ত পড়ার পর জিবরাইল থামলেন এবং তারপর চলে গেলেন। আমি হেরা গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম। পর্বতের মধ্যবর্তী এক স্থানে পৌঁছে হঠাৎ ওপর থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, “হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল আর আমি জিবরাইল।” আমি আসমানের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, জিবরাইল আকাশের দূর দিগন্তে ডানা ছড়িয়ে দিয়ে আছেন এবং বলছেন, “হে মুহাম্মদ! আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আমি জিবরাইল।” আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আকাশের অন্যান্য প্রান্তে তাকিয়ে দেখি, সর্বত্রই তিনি একই আকৃতিতে বিরাজমান। এরপর জিবরাইল অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এ ঘটনার পর মুহাম্মদ (সা.) নিজ গৃহে চলে গেলেন। তখন তাঁর পবিত্র অন্তঃকরণে এক প্রকার অস্থিরতা বিরাজ করছিল। তিনি কাঁপতে কাঁপতে খাদীজা (রাঃ)-কে বললেন, ‘আমাকে শীঘ্র কম্বল দ্বারা ঢেকে দাও।’ খাদীজা (রাঃ) তাঁকে কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। অতঃপর কিছুটা শান্ত ও স্বাভাবিক হয়ে এলে তিনি খাদীজা (রাঃ)-এর কাছে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করলেন। বললেন, ‘আমার নিজের জীবন সম্পর্কে ভয় হচ্ছে।’ খাদীজা (রাঃ) বললেনঃ ‘না, কখনোই নয়। আপনার জীবনের কোনো ভয় নেই। আল্লাহ আপনার প্রতি বিমুখ হবেন না। “এ ঘটনাকে আপনি পরম শুভ লক্ষণ হিসেবে গ্রহণ করুন এবং অবিচল থাকুন। কেননা আপনি আত্মীয়দের হক আদায় করেন, অক্ষম লোকদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। গরীব-মিসকিনদের সাহায্য, পথিক মুসাফিরদের মেহমানদারী করেন। মোট কথা ইনসাফের খাতিরে বিপদ-মুসিবতের সময় আপনিই লোকদের উপকার করে থাকেন। যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, আপনি এ যুগের মানবজাতির জন্য নবী হিসেবে মনোনীত হয়েছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।”

সহধর্মিণীর উপযুক্ত কথাই বটে! হৃদয় যাঁর পবিত্র, সত্যের উপলব্ধি তাঁর কাছে এমনই সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। খাদীজা (রাঃ) যথাসাধ্য সান্ত¡না দিলেন। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে, মানবতার কল্যাণে কাজ করা একটি মহৎ গুণ ও ইবাদত। সে সাথে আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার মাধ্যম। অপর দিকে মানুষের প্রতি জুলুম করা হারাম এবং ধ্বংসের কারণ। বিপদে কেউ তার সাহায্যকারী হবে না। এরপর খাদীজা (রাঃ) মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে প্রবীণ খৃষ্টান ধর্মবেত্তা অরাকা বিন নওফেলের কাছে গেলেন। অরাকা ছিলেন খাদীজা (রাঃ) এর চাচাতো ভাই। তিনি খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং আসমানী কিতাবের জ্ঞানে সুপন্ডিত ছিলেন। বিশেষত: তাওরাত ও ইন্জীল বিশ্বাসীদের নিকট থেকে অনেক জ্ঞান লাভ করেছিলেন। খাদীজা রাসূল (সা.) এর দেখা ও শুনা সমস্ত ঘটনা তাঁর কাছে আদ্যোপান্ত বর্ণনা করলেন। সব শুনে অরাকা বলে উঠলেন, “কুদ্দুসুন কুদ্দুসুন” মহা পবিত্র ফেরেশ্তা! মহা পবিত্র ফেরেশ্তা!। আল্লাহর শপথ করে বলছি, হে খাদীজা, তুমি বিশ্বাস কর, মুহাম্মদের নিকট সেই মহান দূতই এসেছেন যিনি মূসার নিকট আসতেন।

বস্তুতঃ মুহাম্মদ বর্তমান মানব জাতির জন্য নবী মনোনীত হয়েছেন। তাঁকে বল, তিনি যেন অবিচল থাকেন।” তিনি আরো বললেন, হায়! তোমার বংশের লোকেরা যখন তোমাকে বের করে দেবে, তখন পর্যন্ত যদি আমি জীবিত থাকতাম!’ মুহাম্মাদ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার বংশের লোকেরা কী আমাকে বের করে দেবে? অরাকা বললেনঃ ‘তুমি যা কিছু নিয়ে এসেছো তা নিয়ে ইতিপূর্বে যে-ই এসেছে, তার বংশের লোকেরা তাঁর সঙ্গে দুশমনী করেছে। তুমি এটাও নিশ্চিত জেনে রেখো যে, তোমার বাণীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে, নির্যাতন করা হবে। তোমার বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে। আমি যদি তখন পর্যন্ত জীবিত থাকি, তাহলে অবশ্যই আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় প্রকাশ্যভাবে সাহায্য করবো।” এর কিছু দিন পরই অরাকার মৃত্যু ঘটে। শিক্ষনীয় বিষয় হলো অরাকা নিশ্চিত জানেন যে, হক পন্থিদের ওপর বাতেলের পক্ষ থেকে জুলুম নির্যাতনের ষ্টীম রোলার নেমে আসে, হক কে ময়দান থেকে মুছে ফেলার জন্যে। তা সত্ত্বেও তিনি আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে শামীল করার আশা ব্যক্ত করলেন, এর কারণ কী? কেনইবা তিনি জেনে শুনে এ বিপদের পথে ঝুঁকি নিতে চাইলেন? এর কারণ হচ্ছে, জীবনে প্রকৃত সফলতা অর্জনের একমাত্র পথই হলো আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার পথ। আর এ পথে জান ও মালের ঝুঁকি থাকবে এটাই আল্লাহর পরীক্ষা। যারা বুঝে শুনে ঈমানের সাথে এ পথে অংশগ্রহণ করবে তারাই সফলতা অর্জন করবে। দ্বিতীয়ত: এমন কোন নবী ও রাসূল আসেননী যাদের সাথে শক্রতা করা হয়নী। প্রত্যেক যুগেই একদল লোক নবীদের প্রতি জুলুম নির্যাতন করেছে। সে সাথে যারাই নবীদেরকে সঠিকভাবে অনুসরণ করেছেন তাদের উপরও চলতো জুলুম নির্যাতন, যা এখনো অব্যাহত আছে এবং কিয়ামতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।

ওহীর বিরতি: প্রথম ওহী নাযিলের পর কিছুদিন ওহী বন্ধ থাকে। কিন্তু মুহাম্মদ (সা.) যথারীতি হেরা-গুহায় যেতে থাকলেন। এ অবস্থা অন্তত ছয়মাস চলতে থাকলো। বিষয়টি একদিকে তাঁর জন্য খুবই কষ্টকর হয়ে উঠলো। অপরদিকে এ বিরতির ফলে কিছুটা উপকার ও হলো। মানবীয় প্রকৃতির দরুণ তাঁর অন্তঃকরণে এখন ওহী নাযিলের প্রেরণা সঞ্চারিত হলো। এ অবস্থা কিছুটা বিলম্বিত হলে তাঁকে সান্ত¡না দেবার জন্যে জিবরীলের আগমন শুরু হলো। জিবরীল তাঁর কাছে সূরা “আদ্ দুহা” নিয়ে আবির্ভূত হলেন। যে মহান প্রতিপালক তাঁকে নবুওয়াত দ্বারা সম্মানিত করেছেন তিনি ঐ সূরাতে শপথ করে বলেছেন যে, তিনি তাঁকে ত্যাগ করেননি এবং তাঁর প্রতি বৈরীও হননি। মহান আল্লাহ বলেন, “ উজ্জ্বল দিনের কসম এবং রাতের কসম যখন তা নিঝুম হয়ে যায়। তোমার রব তোমাকে কখনো পরিত্যাগ করেননি এবং তোমার প্রতি অসন্তুষ্টও হননি। অর্থাৎ তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে তোমাকে পরিত্যাগ করেননি, আর তোমার প্রতি শত্রুতা পোষণ করার পর পূণরায় ভালো বেসেছেন এমনও হয়নি। নিঃসন্দেহে তোমার জন্য পরবর্তী যুগ পূর্ববর্তী যুগের চেয়ে ভালো। অর্থাৎ আমার নিকট তোমার প্রত্যাবর্তনের পর তোমার জন্য যা প্রস্তুত করে রেখেছি তা দুনিয়াতে তোমাকে যা দিয়েছি তার চেয়ে উত্তম। আর শীঘ্রই তোমার রব তোমাকে এত দেবেন যে, তুমি খুশী হয়ে যাবে। অর্থাৎ দুনিয়ায় সাফল্য ও বিজয় এবং আখিরাতে প্রতিদান। তিনি কী তোমাকে এতিম হিসেবে পাননি? তারপর তোমাকে আশ্রয় দেননি? তিনি তোমাকে পথ না পাওয়া অবস্থায় পান, তারপর তিনিই পথ দেখান। তিনি তোমাকে নিঃস্ব অবস্থায় পান, তারপর তোমাকে ধনী করেন। এ আয়াত ক‘টিতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রথম জীবনে প্রাপ্ত সম্মান এবং তাঁর মাতৃ-পিতৃহীন, সহায় সম্বলহীন ও দিশেহারা অবস্থায় আল্লাহ তাঁর প্রতি যে করুণা ও অনুকম্পা দেখিয়েছেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাঁকে যে শোচনীয় দুরাবস্থা থেকে উদ্ধার করেছেন, তার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। কাজেই তুমি এতিমের প্রতি কঠোর হয়ো না এবং সাহায্য প্রার্থীকে তিরস্কার করো না। অর্থাৎ আল্লাহর দূর্বল বান্দাদের ওপর ঔদ্ধত্য ও অহংকার প্রদর্শন করোনা এবং নিষ্ঠুর ও স্বেচ্ছাচারী আচরণ করোনা। আর তোমার প্রতিপালকের দেয়া নিয়ামতের কথা প্রচার করো।” অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে নবুওয়াত প্রাপ্তির মাধ্যমে যে অতুলনীয় সম্পদ ও অনুপম মর্যাদা তুমি লাভ করেছ, তার কথা মানুষকে জানাও ও তাদেরকে সেদিকে দাওয়াত দাও। এরপর রাসূল (সা.) অতি গোপনে তাঁর নিকটতম লোকদের মধ্য হতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে প্রচারে আত্মনিয়োগ করলেন। আল্লাহ তাঁকে নবুওয়াত দান করে স্বয়ং তাঁর ওপর ও সমগ্র মানব জাতির ওপর যে মহা অনুগ্রহ করেছেন তার কথা ব্যক্ত করতে লাগলেন।

মাক্কী জীবনের চার স্তর: নবুওয়াত ও রিসালাত প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ পাক রাসূল (সা.)-এর ওপর এক বিরাট দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দিলেন। এখান থেকে মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের সংগ্রামী পর্যায় শুরু হলো। এ পর্যায়কে ঐতিহাসিকগণ দু‘টি বড়ো -বড়ো অংশে ভাগ করেছেন। হিজরতের পূর্বে মক্কায় অতিবাহিত অংশ; যাকে বলা হয় মাক্কী পর্যায়। আর হিজরতের পর মদীনায় অতিক্রান্ত অংশ; একে বলা হয় মাদানী পর্যায়। প্রথম পর্যায় ১৩ বছর এবং দ্বিতীয় পর্যায় প্রায় ১০ বছরকাল ছিলো। মক্কী পর্যায় মুহাম্মদ (সঃ)-এর সংগ্রামী জীবনের নিজস্ব পরিণতির দিক দিয়ে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে এই পর্যায়েই ইসলামের ক্ষেত্র কর্ষিত হয়। এ পর্যায়ে মাবনবতার এমন সব উন্নত নমুনা তৈরী হয়, যাদের কল্যাণে উত্তরকালে ইসলামী আন্দোলন সারা দুনিয়ার বুকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এ পর্যায়ের গুরুত্ব এবং এর শিক্ষামূলক ঘটনাবলী অনুধাবন করতে হলে কুরআনের মাক্কী অংশ গভীরভাবে অধ্যয়ন করা দরকার। প্রকৃতপক্ষে এ পর্যায়ের সঠিক গুরুত্ব ঠিক তখন উপলব্ধি করা সম্ভব, যখন মাক্কী সূরাসমূহের প্রকাশ-ভঙ্গী, তখনকার পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর বর্ণনা, তাওহীদ ও আখিরাতের প্রমাণাদি, জীবন ও চরিত্র গঠনের নির্দেশাবলী এবং হক ও বাতিলের চরম সংঘাতকালে আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্যে মুষ্টিমেয় কর্মিদের আপ্রাণ চেষ্টা-সাধনার বিবরণ সামনে আসবে। হিজরতের পূর্বে মুহাম্মদ এবং তাঁর সঙ্গীদের জন্যে অত্যন্ত কঠিন সংকটকাল ছিলো।
প্রথম স্তরঃ
গোপন দাওয়াতঃ নবুওয়াতের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হবার পর প্রথম সমস্যা ছিলোঃ এক আল্লাহর ইবাদত কবুল করে অসংখ্য মিথ্যা রবের অস্তিত্ব অস্বীকার করার দাওয়াত প্রথম কোন্ ধরনের লোকদের দেয়া যাবে? দেশ ও জাতির লোকদের তখন যে অবস্থা ছিলো, তার একটি মোটামুটি ধারণা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের লোকদের সামনে তাদের মেজাজ, পছন্দ ও অভ্যাসের সম্পূর্ণ বিপরীত কোনো জিনিস পেশ করা বাস্তবিকই অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিলো। তাই যে সব লোকের সঙ্গে এতদিন মুহাম্মাদ (সা.) -এর খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিলো এবং যারা তাঁর স্বভাব-প্রকৃতি ও নৈতিক-চরিত্র সম্পর্কে সরাসরি অবহিত ছিলেন, তাঁদেরকেই তিনি সর্বপ্রথম দাওয়াতের জন্যে মনোনীত করলেন। কারণ, এদের তাঁর (রাসূলের) সততা ও বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কোন আপত্তি ছিলো না এবং তিনি কোন কথা বললে তাকে সরাসরি অস্বীকার করা এঁদের পক্ষে সম্ভবপর ছিলো না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন খাদীজা (রাঃ), আলী (রাঃ), জায়েদ (রাঃ), আবু বকর (রাঃ) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ একেবারে সূচনাতেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাক্ষ্য দিয়ে দিলেন যে, আহ্বায়কের সত্যবাদিতা ও আন্তরিকতায় কোন সন্দেহ নেই। আবু বকর (রাঃ) রাসূল (সা.) -এর আন্দোলনের সৈনিক হওয়া মাত্রই নিজের প্রভাবাধীন লোকদের মধ্যে জোরে শোরে কাজ শুরু করে দিলেন। তিনি হযরত ওমর, ওসমান, যুবায়ের, আব্দুর রহমান বিন আওফ, সা‘দ বিন আবি ওয়াক্কাস, তালহা (রাঃ) প্রমুখসহ বেশ কিছু সংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে এ বিপ্লবী আন্দোলনের সদস্য বানিয়ে ফেললেন। অত্যন্ত সতর্কতা, গোপনীয়তা ও নীরবতার মধ্য দিয়ে তারা এ কাজের প্রসার ঘটাতে লাগলেন এবং মুসলমানদের সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেতে লাগলো।

কুরআনের প্রভাবঃ এ পর্যায়ে কুরআনের যে অংশগুলো নাযিল হয়েছিলো, তা ছিলো ইসলামের প্রথম স্তরের উপযোগী ছোট-খাটো বাক্য-সমন্বিত। এর ভাষা ছিলো অতীব প্রাঞ্জল, কবিত্বময় ও হৃদয়গ্রাহী। উপরোন্তু এতে এমন একটা সাহিত্যিক চমক ছিলো যে, শোনার সঙ্গে-সঙ্গেই তা শ্রোতার মনে প্রভাব বিস্তার করতো এবং এক একটি কথা তীরের ন্যায় বিদ্ধ হতো। এসব কথা যে শুনতো তার মনেই প্রভাব বিস্তার করতো এবং বারবার তার আবৃত্তি করার ইচ্ছা জাগতো। আল্লামা শিবলী নু’মানীর মতে হযরত আবু যার (রাঃ) ৬ষ্ঠ বা ৭ম নম্বরে মুসলমান হয়েছিলেন। তিনিও সেই সব ব্যক্তিদের অন্যতম, যারা অস্থিরতায় ভুগছিলেন এবং মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়ে নিছক আপন নির্মল স্বভাব ও বিবেকের তাড়নায় সত্যের সন্ধানে উদগ্রীব হয়েছিলেন। যেভাবেই হোক তিনিও রাসূল (সা.)এর খবর পেলেন। অতঃপর নিজের ভাইকে সঠিক তথ্য জানার জন্য পাঠালেন। তাঁর ভাই রাসূল (সা.)-এর সাথে সাক্ষাত করলেন, এবং কুরআন তেলাওয়াত শুনলেন এবং ফিরে গিয়ে ভাইকে বললেন, “আমি এই দাওয়াত দাতাকে দেখে এসেছি। লোকেরা তাকে ধর্মত্যাগী বলে থাকে। কিন্তু তিনি মহৎ চারিত্রিক গুণাবলী শিক্ষা দেন এবং এমন এক বিস্ময়ের বাণী শোনান, যা মারাসূলয় কবিতা থেকে একেবারেই অন্য রকম। তাঁর চালচলন তোমার অতি পছন্দনীয় মনে হবে।” এরপর তিনি নিজে এলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করলেন। শুধু কি তাই? যে সমস্ত বড়-বড় লিডারগণ ইসলামের ঘোর বিরোধিতায় ছিলো সোচ্চার, তারাও গোপনে কুরআন তেলাওয়াত শুনতো।

আকীদা-বিশ্বাসের সংশোধনঃ কুরআনে কারীমের প্রথম দিকের সূরা গুলোতে তাওহীদ ও আখেরাতের তাৎপর্য বর্ণনা করা হচ্ছিলো। এ ব্যাপারে এমন সব প্রমাণাদি পেশ করা হচ্ছিলো, যা প্রতিটি শ্রোতার মনে বদ্ধমূল হয়ে যাচ্ছিলো। এসব দলীল-প্রমাণ শ্রোতাদের নিকটতম পরিবেশ থেকেই পেশ করা হচ্ছিলো। পরন্তু এসব কথা এমন ভঙ্গীতে পেশ করা হচ্ছিলো, যে সম্পর্কে শ্রোতারা পুরোপুরি অভ্যস্ত ও অবহিত ছিলো। তাদেরই ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথা বোঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছিলো। আকীদা-বিশ্বাসের যেসব ভ্রান্তি সম্পর্কে তারা ওয়াকিফহাল ছিলো, সেগুলো সম্পর্কেই আলোচনা করা হচ্ছিলো। এ কারণেই আল্লাহর এ কালাম শুনে কেউই প্রভাবিত না হয়ে পারছিলো না। আল্লাহর রাসূল প্রথমে একাকীই এই আন্দোলন শুরু করেছিলেন। কিন্তু কুরআনের এ প্রাথমিক আয়াতসমূহ এ ব্যাপারে অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। ফলে গোপনে-গোপনে আন্দোলন অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বিস্তার লাভ করতে থাকে। এ পর্যায়ে দাওয়াত প্রচারের জন্য তাওহীদ ও আখিরাতের দলীল-প্রমাণের সঙ্গে-সঙ্গে এই বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্যে খোদ মুহাম্মাদ (সা.)-কে কিভাবে আত্মপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে এবং কি-কি পন্থা তাঁকে অবলম্বন করতে হবে, সে সম্পর্কেও তাঁকে সরাসরি শিক্ষাদান করা হচ্ছিলো।

গোপনে সালাতঃ এ পর্যন্ত সবকিছু গোপনে গোপনেই হচ্ছিলো। নেহাত বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য লোক ছাড়া বাইরের কারো কাছে যাতে কিছু ফাঁস না হয়ে যায়, সেজন্যে হামেশা সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছিলো। নামাজের সময় হলে মুহাম্মাদ (সা.) আশপাশের কোনো পাহাড়ের ঘাঁটিতে চলে যেতেন এবং সেখানে নামাজ আদায় করতেন। একবার তিনি হযরত আলী (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে কোনো এক জায়গায় নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় তাঁর চাচা আবুতালিব ঘটনাক্রমে সেখানে এসে হাযির হলেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরে ইবাদতের এই নতুন পদ্ধতি তাজ্জবের সাথে লক্ষ্য করলেন। নামাজ শেষ হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কোন্ ধরনের দ্বীন?” জবাব দিলেন, “এটা ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীন।” আবু তালিব বললেনঃ “বেশ, আমি যদিও এটা গ্রহণ করতে পারছি না, তবে তোমাকে পালন করার পুরো অনুমতি দিলাম। কেউ তোমার পথে বাধ সাধতে পারবে না।”

প্রথম যুগের মু‘মিনদের বৈশিষ্ট্যঃ এ যুগের বৈশিষ্ট্য ছিলো এই যে, এ সময়ে ইসলাম গ্রহণ ছিলো প্রকৃতপক্ষে জীবন নিয়ে বাজী খেলার নামান্তর। কাজেই এ যুগে যাঁরা সামনে অগ্রসর হয়ে ইসলামের দাওয়াত কবুল করেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই কিছু অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিলো, যার ভিত্তিতে তাঁরা এ বিপদ-সংকুল পথে অগ্রসর হবার সাহস পেয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো, এসব লোক আগে থেকেই মুশরিকী রসম-রেওয়াজ ও ইবাদত-বন্দেগীর প্রতি অনীহা এবং সত্যের জন্যে অনুসন্ধিৎসু ছিলেন। স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে তাঁরা ছিলেন সৎ ও পুতঃপবিত্র চরিত্রের অধিকারী। গোপনীয়তা অবলম্বন করা সত্ত্বেও সত্যের সুবাস বাতাসের ওপর ভর করেই দিক থেকে দিগন্তে ছুটে যাচ্ছিলো। এ সময়ে রাসূল (সা.)-কে নানা রকমের কু-খেতাব দেয়াও শুরু হয়ে গিয়েছিলো। তথাপি পরিবেশ মোটামুটি শান্ত ও স্বাভাবিক ছিলো। লক্ষনীয় ব্যাপার হলো ইসলামী আন্দোলনের এই প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের মধ্যে একজনও এমন ছিলেন না, যিনি উচ্চতর জাতীয় ও ধর্মীয় পদে আসীন ছিলেন। এর ফলে তাঁরা সকল স্বার্থপরতার বন্ধন থেকে মুক্ত ছিলেন। ইতিহাসে এ ধরনের স্বাধীনচেতা যুবকরাই বড়-বড় পরিবর্তন সূচিত করার জন্য সম্মুখ কাতারে অবস্থান গ্রহণ করে থাকে। নেতা ও পদস্থ ব্যক্তিরা কেউ এ কাজে অবদান রাখেনি। গোপনীয় স্তরের এই ইসলামী আন্দোলনকে কুরাইশ নেতারা কোন গুরুত্ব মনে করেনি। কুরাইশরা আরো মনে করতো যে, লাত, মানাত ও উয্যার মত দেবতাদের আমরা যখন এত ভক্তি ও পূজা করি, তখন তারাই যাবতীয় ব্যাপারে হেফাজত করবে এবং গুটিকয়েক তাওহীদ পন্থীদের খতম করে দেবে।

দ্বিতীয় স্তরঃ

প্রকাশ্য দাওয়াত; প্রায় তিন বছর যাবত দাওয়াত ও প্রচারের কাজ এভাবে গোপনে গোপনে চলতে লাগলো। কিন্তু কতোদিন আর এমনিভাবে চলা যায়! যে সূর্যকে আপন রশ্মি দ্বারা সারা দুনিয়াকে আলোকময় করে তুলতে হবে, তাকে তো লোকচক্ষুর সামনে আত্মপ্রকাশ করতে হবেই। ইতিমধ্যেই লোকেরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আসতে শুরু করে। ফলে মক্কার সর্বত্র ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে থাকে। পরিস্থিতি চিরদিন একইভাবে থাকতে দেয়া আল্লাহর রীতি নয়। আল্লাহর বাণী, “আমি এ দিবসসমূহকে মানুষের মধ্যে পালাবদল করাই; এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাদেরকে আল্লাহ এরূপে প্রকাশ করেন।” (ইমরান-১৪০)। তিনি বাতিলের প্রতিরোধের জন্য সত্যকে সামনে নিয়ে আসেন। আল্লাহর বাণী; “আমি সত্য দ্বারা আঘাত হানি মিথ্যার উপর; ফলে ওটা মিথ্যাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ মিথ্যা উৎখাত হয়ে যায়।” (আম্বিয়া-১৮)। আল্লাহর এই চিরাচরিত রীতি অনুসারে আদেশ জারী হলোঃ “অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছো, প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকেদের উপেক্ষা কর।” (হিজর-৯৪)। তিনি আরো বলেন, “তোমার নিকটাত্মীয়দের সতর্ক করে দাও এবং যারা তোমার অনুসরণ করে সেই সব মুমিনের প্রতি বিনয়ী হও। আর বলোঃ আমি প্রকাশ্য সতর্ককারী।” (শুআ‘রা-২১৪,২১৫)।
রাসূল (সাঃ) সমস্ত হিম্মত ও সাহস সঞ্চয় করে, নতুন সম্ভাব্য সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে একদিন সাফা পর্বতের ওপর এসে দাঁড়িয়ে আরবের বিশেষ রীতি অনুযায়ী কুরাইশ জনতাকে বিশেষ সাংকেতিক ধ্বনি দিয়ে ডাক দিলে লোকেরা ছুটে এলো। সবাই রুদ্ধশ্বাসে কান পেতে রইল কী হয়েছে, জানার জন্য। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ ‘আমি যদি তোমাদের বলি, এ পাহাড়ের অপর পাশে হানাদার বাহিনী তোমাদের ওপর আক্রমণ চালাতে ছুটে আসছে, তাহলে তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করবে?’ সবাই সমবেত স্বরে বলে উঠলোঃ হ্যাঁ, কেন করবোনা? আমরা তোমাকে সব সময় সত্য কথাই বলতে দেখেছি এবং আমরা তোমাকে আল্ আমীন বলেই জানি। রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তাহলে শোনো, আমি বলছি, তোমরা এক আল্লাহকে প্রভু ও উপাস্য মেনে নাও, আর মূর্তি-পূজা ছেড়ে দাও। নচেত তোমাদের ওপর কঠিন শাস্তি নেমে আসবে।’ যখনই তিনি তাদেরকে মহা-সত্যের দিকে আহবান জানালেন ঠিক তখন থেকেই তারা তাঁর মিশনকে একটা ভয়ংকর ও মারাত্মক বলে মনে করলো, তাঁর বিরুদ্ধে প্রচন্ডভাবে ক্ষেপে উঠলো। তাঁর চাচা আবু লাহাব কথাটা শোনা মাত্রই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললো, ‘ওরে হতভাগা তুই আজকের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যা। এই কথা বলার জন্যই কি আমাদের এখানে ডেকেছিলি?’ আবু লাহাবের সাথে অন্যরাও খুবই ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গেল। অথচ তারাই তাঁকে আল্ আমীন (বিশ্বস্ত) বলে স্বীকার করে নিয়ে ছিলো। তাঁর কাছে তাদের সম্পদ আমানত রাখতো এবং বিচার-ফয়সালার ভার তাঁর ওপর ন্যাস্ত করতো। যেই সততা নিষ্ঠার কারণে তাকে ভালো বাসতো সেই সত্য নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠা করার কথা যখনই বলা হলো তখনই তারা তা বরদাশত করতে পারলো না মহাশত্রু মনে করলো এবং শত্রুতায় কোমর বেঁধে নামলো। বাতিলরা যে সব সময় সত্যের বিপক্ষে অবস্থান নিবে সে কথা আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলসহ (সাঃ) বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন পবিত্র কুরআনুল কারীমে। আল্লাহর বাণী, “তিনি সেই আল্লাহ যিনি তাঁর রাসূলকে হেদায়াত (কুরআন) এবং সত্য ধর্ম সহকারে প্রেরণ করেছেন, যেন ওকে সকল ধর্মের উপর বিজয়ী করে দেন, যদিও মুশরিকদের জ্বালা ধরে।” (তাওবা: ৩৩ ফাত্হ: ২৮ ছফ: ৯)। জাহেলিয়্যাতের যুগের মানুষগুলো না হয় রাসূল (সাঃ)-কে রাসূল হিসেবে মেনে নিতে চায়নি তাই তারা বিরোধিতা করেছে। কিন্তু আজ আমরা কি করছি? আমরাতো রাসূল (সাঃ)-কে মেনে নিয়েছি, বিশ্বাস করেছি, রাসূল প্রেমিক বলে দাবীও করি। অথচ রাসূল (সাঃ)-এর নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক তা আমাদের ভালো লাগে না, বিরোধীতা করি, শত্রুতা পোষণ করি। অথচ এ কাজে আত্মনিয়োগ করা প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফরজ। যে কারণে কাফের মুশরিকদের জ্বালা ধরে তা যদি আমাদের ও স্পর্শ করে তাহলে আমাদের অবস্থান কোথায়? আল্লাহর বাণী: “ঈমানের নিয়ামত একবার লাভ করার পর পুনরায় যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে, তাদেরকে আল্লাহ হিদায়াত দান করবেন, এটা কেমন করে সম্ভব হতে পারে? অথচ তারা নিজেরা সাক্ষ দিয়েছে যে, রাসূল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তাদের নিকট প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ এসেছিল, আল্লাহ অত্যাচারী সম্প্রদায়কে পথ-প্রদর্শন করেন না।” (ইমরান-৮৬)। যারা রাসূল (সাঃ)-এর নীতি সমাজে প্রতিষ্ঠার কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের সহযোগিতা না করে বরং কি ভাবে তাদের উৎখাত করা যায় সে চেষ্টা যারা করেন তাদের সাথে আর জাহেলিয়্যাতের সেই লোকদের সাথে পার্থক্য কোথায়? আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, দুনিয়ার এ জীবনে আল্লাহ মানুষকে কিছুটা কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন বটে, কিন্তু আসলে দুনিয়ার জীবন একটা পরীক্ষাকাল ছাড়া আর কিছুই নয়। এ পরীক্ষার পর অবশ্যই মানুষকে আল্লাহর কাছে ফিরে যেতে হবে এবং তিনি সমস্ত কাজ-কর্ম যাচাই করে পরীক্ষার সাফল্য ও ব্যর্থতা সম্পর্কে ফলাফল ঘোষণা করবেন।

রাসূল (সাঃ)-এর প্রথম ঘোষণা কোন মামুলী ব্যাপার ছিলো না। এর ফলে গোটা কুরাইশ এবং অন্যান্য গোত্রের ভেতর আগুন জ্বলে উঠলো এবং চারদিকে এ সম্পর্কে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেলো। কয়েকদিন পর রাসূল (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে একটি ভোজ সভার আয়োজন করতে বললেন। এতে গোটা আব্দুল মুত্তালিব খান্দানকে আমন্ত্রণ করা হলো। এ ভোজসভায় হামজাহ্, আবুতালিব, আব্বাস প্রমুখ সবাই শরীক হলেন। পানাহারের পর মুহাম্মদ (সাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, “আমি এমন একটি জিনিস নিয়ে এসেছি, যা দ্বীন ও দুনিয়া উভয়ের জন্যেই যথেষ্ট। এই বিরাট বোঝা উত্তোলনে কে আমার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছেন?” এটা ছিলো অত্যন্ত কঠিন সময়। চারদিকে শুধু বিরোধিতার ঝান্ডা উত্তোলিত হচ্ছিলো। সুতরাং এ -বোঝা উত্তোলনে সহযোগিতা করার অর্থ ছিলো এই যে, শুধু দু’একটি খান্দান, গোত্র বা শহরের লোকদেরই নয়, বরং গোটা আরবের বিরোধিতার মুকাবিলা করার জন্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রস্তুত হতে হবে। তাকে এজন্যেও তৈরী হতে হবে যে, এর বিনিময়ে শুধু তার আখিরাতের জিন্দেগী সফলকাম হবে এবং সে আপন মালিকের সন্তুষ্টি লাভ করতে পারবে। এছাড়া দূরব্যাপী দৃষ্টিনিক্ষেপ করেও আপাতত ফায়দা লাভের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিলো না। ফলে সমস্ত মজলিসের ওপর একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। উঠে দাঁড়ালেন শুধু কিশোর আলী। তিনি বললেন, “আমার চোখে যদিও যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে, আমার হাঁটুদ্বয়ও অত্যন্ত পাতলা, বয়সেও আমি সবার ছোট, তবুও আমি আপনার সহযোগিতা করে যাবো।” মাত্র তেরো বছর বয়সের একটি বালক না বুঝে-শুনে এত বড় একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলো। গোটা কুরাইশ খান্দানের পক্ষে এটা ছিলো এক বিস্ময়কর দৃশ্য। তারা অট্টহাসীতে ফেটে পড়লো। এবং তারা ভাবলো এসব একটা তামাশা, পাগলামী ছাড়া আর কিছু নয়।

উস্কানী ও উত্তেজনার আবহ সৃষ্টি
তৃতীয় পদক্ষেপের সময় থেকে শুরু হলো উস্কানী, উত্তেজনা ও বিরোধিতা। এ পর্যন্ত মুসলমানদের সংখ্যা চল্লিশ বা তার চেয়ে কিছু বেশী হয়েছিলো। রাসূল (সা.) এবার কা‘বা শরীফে গিয়ে ইসলামের প্রকাশ্যে দাওয়াত দিলেন। কা‘বা ঘরে ইসলামের প্রকাশ্য ঘোষণা কুরাইশদের নিকট এটা ছিলো কা‘বা শরীফের সবচেয়ে বড়ো অবমাননা। ধর্মীয় চেতনা যখন বিকৃত হয়ে যায়, তখন মানুষের ভালো-মন্দ পার্থক্য করার জ্ঞান হারিয়ে যায়। তা না হলে যে পবিত্র আল্লাহর ঘর একদিন তাওহীদের বাণী প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার চত্তরে আল্লাহর বাণী প্রচার করায় কা‘বা অবমাননার কারণ হিসেবে চিন্হিত হলো। বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার যে, অতগুলো মূর্তি স্থাপনে কা‘বার অবমাননা হয়না,মূর্তির সামনে কপাল ঘষলেও তার অবমাননা হয়না, উলংগ হয়ে তওয়াফ করলে, উলু ধ্বনি দিলে এবং তালি বাজালেও তার পবিত্রতা হানি হয়না। দেবদেবীর নামে জানোয়ার বলি দিলে এবং পুরোহিতগিরি ও খাদেমগিরির কর আদায় করলেও কা‘বার অপমান হয়না। অপমান হয় শধু ঐ ঘরের আসল মালিকের নাম নিলেই। বড়ই বিচিত্র বিবেক মানুষের! যে আল্লাহ সৃষ্টি করে লালন-পালন করছেন, সে আল্লাহর জমিনে তাঁর ইবাদতের আহবান করা মহা অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়। আজকের মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ স্থানের অবস্থাও কি তেমনি মনে হয়না? মুসলিম দেশে বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা চলে, সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া-লটারী, গান-বাজনা, উলংগপনা-বেহায়াপনা, জবর দখল, মারা-মারী, হানা-হানী, দুর্নীতি,নারী ধর্ষণ-নির্যাতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানুষ হত্যা, এমন কি জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে যারা বিদেশী রাজনীতির তল্পীবাহক হয়ে কাজ করেন,তাদের যতটানা অপরাধী মনে করা হয়,তার চেয়েও বেশী অপরাধী মনে করা হয় যারা সঠিক ভাবে আল্লাহর দিকে আহবান করছেন তাদের। আল্লাহর বাণী, “তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে চাচ্ছ না? (নূহ্ ১৩)। অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও যুক্তিসংগত পন্থায় যে দাওয়াত দেয়া হয়, তা নিযে বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং যুক্তির জবাব যুক্তির মাধ্যমে দেয়ার পরিবর্তে অন্ধ আবেগ ও উন্মত্ত হিংস্রতা দিয়ে তার জবাব দেয়া হয়। একটা বাতিল ব্যবস্থায় স্বার্থপর হোতাদের এটাই বৈশিষ্ট্য যে,তারা যুক্তির জবাবে উস্কানী ও উত্তেজনা এবং প্রমাণের জবাবে হিংস্রতা সৃষ্টি করে। এটা হচ্ছে ধর্মীয় বিকৃতির ফল। রাসূল (সা.)-এর তাওহীদের ঘোষণার পর আওয়ায উঠলোঃ কা‘বার অবমাননা করা হয়েছে, হারাম শরীফের সম্মানহানি করা হয়েছে। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! মাথায় রক্ত চড়িয়ে দেয়ার মত উস্কানীদায়ক কাজ প্রচন্ড উত্তেজনায় বেসামাল ও আবেগে দিশেহারা কুরাইশরা চারদিক থেকে ধেয়ে আসলো। গোলযোগের সূত্রপাত হলো। রাসূল (সা.) ঘেরাও হয়ে গেলেন। হারেস বিন উবাই হৈ চৈ শুনে রাসূল (সা.) কে রক্ষা করতে ছুটে এলেন। কিন্তু তরবারীর আঘাতে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন। আরবে ইসলাম ও জাহেলিয়াতের সংঘাতে এটাই ছিল ইসলাম রক্ষার লক্ষ্যে সংঘটিত প্রথম শাহাদাত। কুরাইশদের মধ্যে এতটুকু ভাববার সময় ছিলনা যে কা‘বা ঘরে মুহাম্মাদ (সা.)-এর ও অধিকার আছে? তাছাড়া মুহাম্মাদ(সা.)-এর প্রচারিত মতাদর্শে যদি ত্রুটি থাকে সে ত্রুটি শুধরাবার ব্যবস্থাও থাকতে পারে। আসলে কোন বাতিল ব্যবস্থার নেতাদের মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতা একেবারেই শেষ হয়ে যায় এবং তাদের চিন্তাভাবনা ও বিচার বিবেচনার যোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। অপর দিকে তাদের মধ্যে নানারূপ দু®কৃতি অনৈতিক ও গর্হিত কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যা সমাজের সাধারন মানুষ জানলেও তার প্রতিবাদ করতে সাহস পায়না। কিন্তু মুহাম্মাদ (সা.) সে সব নেতাদের বুনিয়াদী চরিত্রের দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো থেকে বাঁচার জন্যে তাদের উপদেশ দিচ্ছিলেন। ফলে জনসাধারণের মধ্যে এসব কথা প্রচারিত হতেই তারা আতংকিত হলো। তারা উপলব্ধি করলো যে, লোকচক্ষে তাদের মর্যাদার অবনতি ঘটছে এবং সামনা-সামনি না হলেও অন্তত পেছনে অবশ্যই তাদের সমালোচনা হচ্ছে। পরন্তু কুরআন মাজীদে এই ধরনের দুশ্চরিত্র ও দু®কৃতিকারী লোকদের সম্পর্কে বারবার আয়াত নাযিল হচ্ছিলো এবং তাদের এই শ্রেণীর কীর্তিকলাপের জন্যে কঠোর আজাবের ভয় প্রদর্শন করা হচ্ছিলো। এ সকল আয়াত যখন সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হতে লাগলো, তখন কোথাকার পানি কোন্ দিকে গড়াচ্ছে,তা সবাই স্পষ্টত উপলব্ধি করতে পারলো। ইসলামের প্রসার যতই বাড়বে ততই তাদের সমস্ত কায়েমী স্বার্থ ক্ষমতা প্রভাব প্রতিপত্তিই ধুলিসাৎ হয়ে যাবে। কাজেই এ নয়া বিপদের নাম নিশানা মুছে ফেলতেই নেতারা বিরোধীতার সব হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করলো। একটু ভাবতে চেষ্টা করি তো সেই পরিবেশটা আর আজকের পরিবেশের পার্থক্য কোথায়? যেখানে আমাদের সকলের ইহ-পরকালের কল্যাণের জন্য প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে একেবারেই নিরস্ত্র ও নিসম্বল অবস্থায় আপন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.)।
অপপ্রচার
সত্যের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রমাণ সহকারে বক্তব্য দিতে অক্ষম লোকদের একমাত্র সম্বল হয়ে থাকে নেতিবাচক প্রচারণা। বিরোধিতার প্রথম স্তর সব সময়ই ঠাট্টা বিদ্রুপ, উপহাস ও কূটতর্কের মধ্য দিয়েই অতিবাহিত হয় এবং ক্রমান্বয়ে তা সন্ত্রাস-গুন্ডামীর রূপ ধারণ করে। রাসূল (সা.)-এর দাওয়াতের গুরুত্ব কমানোর উদ্দেশ্যে গালিগালাজের ঘৃণ্য ইতরামির পাশাপাশি রকমারি উপাধি প্রণয়নের কাজও শুরু করে দিল অপপ্রচারের দক্ষ কুশলীরা। কেউ বললো, এই ব্যক্তি পূর্বপুরুষদের চিরাচরিত ধর্মকে ত্যাগ করেছে বিধায় সে ধর্মত্যাগী। কখনো বলা হতো, সে নক্ষত্র পূজারী। কখনো যাদুকর, গণক, করি, জ্বিনে ধরেছে, ইত্যাদি শব্দ ব্যাবহার করতো। মক্কার প্রত্যেক অলিতে-গলিতে, সভা-সমিতিতে এ ধরণের প্রচার প্রপাগান্ডা চালানো হতো। এ ধরনের প্রচারণার ঝড় যখন উঠতো তখন সাধারণ মানুষের জন্য পরিবেশ যে কত ভারী ও শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠে এবং সঠিক পথের সন্ধান করা যে কত দুরূহ হয়ে উঠে তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। এরূপ পরিবেশে সত্যের সেই ক্ষুদ্র কাফেলা যে কী সংকটের সম্মুখীন ছিল, তা কল্পনা করাও বোধ হয় সহজসাধ্য নয়। সত্যের বাহকদের আজকের বিপদও সে পথেই এগুচ্ছে বলে মনে হয়। কিন্তু পরিস্থিতি ও পরিবেশ যতই বিপদ সংকুল হোক, তা দৃঢ়চেতা ও কৃত সংকল্প সত্যের বাহকদের পথ রুখতে পারবে না। আল্লাহর বাণী, “আল্লাহ মানুষের জন্য যে অনুগ্রহ উন্মুক্ত করেন, তা কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারেনা।” (ফাতির-২)। অপপ্রচারে আবেগের বশবর্তী হয়ে মানুষ কিছূ দিন বিশ্বাস করলেও অচিরেই তা নি¯প্রভ ও ম্লান হয়ে মানুষের মন তার প্রতি বিরক্ত ও বিতৃষ্ণ হয়ে যায়। তাই এ কাজে যারা অভিজ্ঞ, তাদের মূলনীতি হলো নিত্যনতুন প্রপাগান্ডা আবিস্কার করে যেতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার তারা নতুন শব্দ যোগ করে প্রচার চালালো যে, মুহাম্মদ (সা.) একটা পাগল, উম্মাদ ও নির্বোধ ছাড়া আর কিছু নয়। কুরআনুল কারীমে সূরা আল্ হিজরের ছয় নাম্বার আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, “তারা বলেঃ ওহে যার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে ! তুমি তো একটা পাগল (উম্মাদ) ছাড়া আর কিছু নও।” কোন আন্দোলনের কেন্দ্রীয় ও প্রধান ব্যক্তিত্বকে যখন এ ধরনের হীন আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, তখন শুধু ঐ ব্যক্তিকে কষ্ট দেয়াই আসল লক্ষ্য হয়না, বরং আসল লক্ষ্য হয়ে থাকে ঐ মতবাদ ও মতাদর্শকে এবং ঐ আন্দোলনকে হেয় করা ও তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা যার ক্রমবর্ধমান প্রসারে বিরোধীরা আতংকিত থাকে। মজার ব্যাপার হলো, একদিকে বাপদাদার ধর্মের সম্পূর্ণ বিরোধী নতুন ধর্ম প্রচারের দায়ে রাসূল (সা.) কে অভিযুক্ত করা হচ্ছিল। অপরদিকে সেই রাসূলের (সা.)-এর পেশ করা বাণীকেই প্রাচীন কিস্সা কাহিনী বলে নিন্দা করা হচ্ছিল। মতলববাজ কুচক্রীদের এটা চিরাচরিত স্বভাব যে, আগপাছ চিন্তা-ভাবনা না করে কখনো একদিক থেকে একটা খুঁত ধরে, আবার কখনো অন্যদিক থেকে আক্রমণ করে ঠিক তার বিপরীত আপত্তি তোলে। অথচ তারা ভেবেও দেখেনা যে, এভাবে তারা স্ববিরোধী আচরণই করছে। দুনিয়ার সুখ সমৃদ্ধি বাড়ানো এবং নিজেদের লোভ-লালসা ও কামনা বাসনা চরিতার্থ করার জন্য সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া যাদের স্বভাব, তাদেরকেই বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ লোক মনে করা হয়। পক্ষান্তরে সমাজের সংস্কার ও সংশোধনের কর্মসূচী গ্রহণ করে যারা নিজেদের জীবনকে জনগনের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন, তাদেরকে নানা সময় নানা ধরনের যুগ উপযোগী ধারা বজায় রেখে স্থান কাল পাত্র ভেদে নতুন নতুন শব্দ তৈরী করে জনগণকে ধোকা দেয়ার প্রচেষ্টায় অপপ্রচার চালিয়ে তাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়, যার ধারা আজো আছে এবং কিয়ামতের আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
কুটতর্ক ও যুক্তি
যারা চাক্ষুষ সত্যকে মানতে চায়নী, তারা নিজেদের ও দাওয়াতদাতার মাঝে নানা রকমের কুটতর্ক বাধিয়ে অন্তরায় সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাতো। একটা ব্যর্থ হলে আরেকটা শুরু করা হতো। এ ধরনের অপচেষ্টায় লিপ্ত লোকদের গোটাজীবনই এতে নষ্ট হয়ে যায়, অথচ তারা না পারে নিজেদের কোন উপকার করতে, আর না পারে অন্যদের কোন গঠনমূলক সেবা করতে। আন্তরিকতার সাথে যে প্রশ্ন ও আপত্তি তোলা হয়, তার ধরন হয় এক, আর চক্রান্তমূলকভাবে দাওয়াতদাতার পথ আটকানোর জন্য যে প্রশ্ন ও আপত্তি তোলাকে বলা হয় কুটতর্ক। কুটতর্ক সবসময় দুরভিসন্ধি ও ষড়যন্ত্রের প্রতীক হয়ে থাকে। কুটতর্ক কারীদের বৈশিষ্ট হলো, তারা দাওয়াত থেকে কিছুই শিখতে চায়না, বরং তাতে কৃত্রিমভাবে কোন না কোন বক্রতা অন্বেষণ করে। আল্লাহর বাণী, “ যারা আল্লাহর পথ হতে নিবৃত্ত রাখতো এবং ওতে বক্রতা বের করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকতো; আর তারা পরকালেরও অমান্যকারী ছিল।” (হুদ-১৯)। তারা আরো বলতো এ কেমন নবী যে, আমাদের মতই বাজারে যায়, বিবাহ শাদী করে, তার সাথে কেন ফেরেশ্তা থাকেনা, কুরআন এক সাথে কেন নাযিল হলোনা। তুমিতো আমাদের মধ্য গরীব, তোমার উপর জুলুম করলেও কোন বিপদ নেমে আসেনা, কিয়ামত কবে সংঘটিত হবে ইত্যাদি বহু ধরনের উদ্ভট তর্ক বিতর্ক করতো। কুটতর্কে এ তান্ডবের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হবার সময় রাসূল (সা.) যে মানসিক নির্যাতন ও কষ্ট ভোগ করেছেন, তার পুরো প্রতিচ্ছবি কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। এ স্তরটা ধৈর্যের সাথে পেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ পাক বলেছেঃ “ক্ষমার নীতি অবলম্বন কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অজ্ঞ লোকদের এড়িয়ে চলো।” (আ‘রাফ-১৯৯)। রাসূল (সা.) আল্লাহ পাকের এ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তাদের দুরভিসন্ধির মোকাবেলা করেছেন।

এরপর কুরাইশরা যুক্তির মাধ্যমে ইসলামের বিরোধিতার পথ বেছে নিলো। তারা মাঝে মাঝে যুক্তি দিয়ে বলতো, আমরা তো দেব মূর্তিগুলোকে আল্লাহর চেয়ে বড় কখনো মনে করিনা। আমরা শুধু বলি, এ মূর্তিগুলো যে সব মহান ব্যক্তির আত্মার প্রতীক, তারা আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্য সুপারিশ করতে পাারে। এ সব মূর্তির সামনে সিজদা করে ও বলি দিয়ে আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে থাকি। এরকম যুক্তি বর্তমান কালেও আমাদের দেশে বহুল প্রচলিত। কতিপয় ভন্ডপীর ও মাজার পন্থীদের ধোকায় পড়ে সহজ সরল মুসলমানদের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে তাদের ঈমান হারা করছে। তারা বলে মাজারে মান্নত করলে তাদের মনো বাসনা পূর্ণ হবে আর ভন্ডপীরের উছিলায় পরকালে নাজাত পাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সে সময়ে কুরআন মাজীদে তাদের সে সব কুটতর্ক ও যুক্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হচ্ছিলো। উদাহরণ স্বরূপ সূরায়ে কলমে রাসূল (সা.) কে সান্ত¡নার জন্যে বলা হলোঃ আপনার প্রতি আল্লাহ খুবই মেহেরবান। আপনি পাগল নন; আপনার প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুগ্রহ রয়েছে। কার জ্ঞান-বুদ্ধি বিকৃত হয়ে গেছে, তা খুব শীগ্রই জানা যাবে। আপনার প্রভু ভালো করেই জানেন যে, কে ঠিক পথে রয়েছে আর কে পথভ্রষ্ট হয়েছে। নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকুন। যারা ইসলামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চায়, তাদের কথা মোটেও কর্ণপাত করবেন না। তারা চায় যে, আপনি আপনার প্রচার কাজে শৈথিল্য প্রদর্শন করুন তো তাদের তৎপরতাও শিথিল হয়ে আসবে। কিন্তু ঐ সব লোকের প্রবৃত্তি অনুসরণ করা আপনার কাজ নয়। আপনার আহবান যারা মানতে রাজী নয়, তাদের ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দিন। তারা যথাশিগ্রই জানতে পারবে যে, তাদের যে অবকাশ দেয়া হয়েছিলো, তার তাৎপর্য কি? আপনি জিজ্ঞেস করুনঃ আমি কি তোমাদের কাছে কিছু প্রার্থনা করছি? না নিজের ফায়দার জন্যে কিছু দাবি করছি? বা আমার কথার বিরুদ্ধে তোমাদের কাছে কোনো যুক্তি-প্রমাণ আছে? এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, তাদের কাছে এ ধরনের প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। আপনি অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতির মুকাবেলা করুন। যথাসময়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবেই। এ ধরনের বাণী বার বার নাযিল হাচ্ছলো। তাতে লোকদের স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হলো যে, সত্যের আহবায়ক না পাগল, না গণক, না কবি, না জাদুকর। এ ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলো তোমাদের সামনে রাখো এবং সত্যের আহবায়কের ভিতর তার কোন্ কোন্ লক্ষণ পাওয়া যায়, তা- ও বিচার করে দেখ। তিনি যে কালাম পেশ করেছেন, তাঁর প্রতিটি কাজের মাধ্যমে যে চরিত্র প্রতিভাত হচ্ছে এবং তোমাদের মাঝে তিনি যে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছেন, তার কোনটির সাথে পাগল, কবি ও জাদুকরের তূলনা হতে পারে?

সন্ত্রাস ও গুণ্ডামী
নেতিবাচক ষড়যন্ত্রের হোতারা যখন তাদের অপপ্রচার ব্যর্থ হতে দেখে, তখন গুন্ডামী ও সন্ত্রাসই হয়ে থাকে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। কুরাইশরা রাসূল (সা.)-এর সাথে যে অমানবিক আচরণ করেছে সে জাগায় তিনি ছাড়া অন্য কেউ হলে তিনি হতাশ হয়ে কাজ ছেড়ে দিতেন। কিন্তু রাসূল (সা.)-এর ভদ্রতা , গাম্ভীর্যতা ও ধৈর্য সকল সহিংসতা ও গুন্ডামীকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। মক্কার বড় বড় মোড়ল ও গোত্রপতি তাঁর পথে নিয়মিতভাবে কাঁটা বিছাতো, তাঁর নামায পড়ার সময় ঠাট্টা বিদ্রুপ আর হৈ চৈ করতো। সিজদার সময় তাঁর পিঠের ওপর জবাই করা পশুর নাড়িভূড়ি নিক্ষেপ করতো। চাদর পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিত, মহল্লার বালক বালিকাদেরকে লেলিয়ে দিত এবং কুরআন পড়ার সময় তাঁকে, কুরআনকে এবং আল্লাহকে গালি দিত। রাসূল (সা.)-এর সাথে এ ধরনের অমানবিক আচরণের সাথে জড়িত জ্ঞানপাপীরা ভেবেছিল এবার কুরআনের আওয়ায শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু যাঁকে কাঁটা বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হলো, তিনি সব সময় ফুল বর্ষণ করতে লাগলেন। যাঁর গায়ে ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ করা হলো, তিনি জাতিকে ক্রমাগত ভালবাসার আতর গোলাপ বিতরণ করতে লাগলেন। যার ঘাড়ে নাড়িভূড়ির বোঝা চাপানো হলো, তিনি মানবজাতির ঘাড়ের ওপর থেকে বাতিলের ভূত নামিয়ে যেতে থাকলেন। যাঁর গলায় ফাঁস দেয়া হলো, তিনি সভ্যতার গলা থেকে বাতিল রসম রেওয়াজের শেকল খুলে ফেললেন। সহিংসতা আর গুন্ডামী এক মহূর্তের জন্যও ভদ্রতার পথ আটকাতে পারেনি। ভদ্রতা ও শালীনতার পতাবাহিরা যদি যথার্থই কৃত সংকল্প হয়, তবে মানবেতিহাসের শাশ্বত নিয়মের পরিপন্থী সন্ত্রাস ও গুন্ডামীকে এভাবেই চরম শাস্তি দিয়ে চিরতরে নির্মূল করে সমাজে শান্তি আনতে পারে। আর এ কাজে যারা এগিয়ে আসে তাদের জীবনই সার্থক।



ইসলামের গতিরোধ করার অপচেষ্টা

ইসলামের প্রচারকার্য যখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর প্রসার ব্যাপকতা ছড়ায় তখন বিপক্ষ শক্তির মাথার ওপর দিয়ে ঝড় বইতে থাকে, তখন বিরোধীরা বেশামাল হয়ে তার নেতা ও কর্মীদেরকে সমাজের সব ধরনের কার্যকর সমর্থন ও পৃষ্টপোষকতা থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চালায়। কুরাইশগণ ইসলামের দাওয়াতী কাজে নানা ধরনের বাধা এবং চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। এমন কি তারা রাসূল (সাঃ)-কে শেষ করে দিতে চাইত। জনগণকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখার লক্ষ্যে কিছু কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করতো। যেমন, তারা বলতো মুহাম্মদ তোমাদের ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে, তোমাদের দেবদেবীকে গালি দিচ্ছে। সে চিরাচরিত ও পৈত্রিক ধর্মের দোষ প্রচার করে বেড়াচ্ছে এবং পূর্ব পুরুষদের অবমাননা করছে। এসব কথা প্রচার করে তারা মোশরেকদের উত্তেজিত করতো। অথচ কখনো তাদের দেবদেবী এবং ধর্মকে গালি দেয়া বা অপমান করা হয়নী বরং নিষেধ করা হয়েছে। তিনি সত্য কথাটাই স্পষ্ট করে বলেছেন যে, কোন জিনিস সত্য-মিথ্যার যাচাই না করে শুধু পুরুষানুক্রমে চলে আসছে এ অজুহাতে ধারণ করে চলা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আর ধর্মীয় ব্যাপারে র্শিক বেদ’আত মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে বলা হয়েছে। এটাকেই তারা প্রচার করেছে ধর্মের অবমাননা বলে। এ ব্যাপারে তারা বার বার রাসূল (সাঃ)- এর চাচা আবু তালেবের নিকট অভিযোগ করে আসছেলো। এ বার তারা সরাসরি বলে দিলো যে, আপনি যদি ওকে না ঠেকান তাহলে আমরা ওকে এবং আপনাকেও দেখে নেব!। হয় আমরা বেঁচে থাকবো, না হয় মুহাম্মদ ও তার সমর্থকরা বেঁচে থাকবে। চাচা আবু তালেব এবার রাসূল (সাঃ) কে অনুনয় করে বললেনঃ ভাতিজা আমার ওপর এমন বোঝা চাপিওনা যা, বহন করতে পারি না। রাসূল (সাঃ) পরিস্কার জানিয়ে দিলেন চাচাজান, যে কোন মূল্যেই হোক আমাকে এ কাজ থেকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না। তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এনে দেয় তবুও আমি দাওয়াতী কাজ পরিত্যাগ করতে পারবোনা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার চেষ্টা সাধনা চলবে। তাতে যে কোন কঠিন পরিস্থিতিরই মোকাবেলা করতে হোক না কেন। এ কথায় আমরা সে আসল শক্তির কন্ঠস্বর শুনতে পাই. যে শক্তি ইতিহাসকে পরিবর্তন করে দেয় এবং বাতিলের সকল ষড়যন্ত্র ও প্রতিরোধকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আপন লক্ষ্যে উপনীত হয়। কিন্তু বাতেলের ধারক বাহকরা সে শক্তি টের পায়না। পরিতাপের বিষয় হলো আজকের বিশ্বেও সে ধরনেরই কাজ চলছে আর কতিপয় নামধারী মুসলমানরা সে কাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। বিশ্ব মোড়লরা নানা অজুহাতে মহাসত্যের ধারক বাহকদের উপর জুলুম-নির্যাতন করে চলেছে আর বিভিন্ন মিথ্যা কাল্পনিক অপবাদের মাধ্যমে মুসলিম দেশসমূহে অরাজকতা সৃষ্টি করে তা দখল করে নিচ্ছে। কোরেশদের শত জুলুম-নির্যাতন নিষ্পেষণ ও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও সে সময় যেমন ইসলামের গতি প্রতিরোধ করা যায়নি, আজো ইসলামের গতিরোধ করার মত কোন ক্ষমতা বিশ্বে কারো নেই।

নেতিবাচক (বাম ) ফ্রন্ট গঠন

শ্রেষ্ঠ মানুষ মুহাম্মদ (সাঃ) মানবজাতির যে বৃহত্তম সেবায় নিয়োজিত ছিলেন, তাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য ইসলামের শত্রুরা হরেক রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর দাওয়াতী কাজ অব্যাহত ছিল এবং তার সুফলও কিছু না কিছু পাওয়া যাচ্ছিল। এমতাবস্থায় বিরুদ্ধবাদী প্রচারণার একটা সক্রিয় সেল গঠন করা হলো। এই সেলের আওতায় মক্কার কতিপয় শীর্ষস্থানীয় নেতা রাসূল (সাঃ)-এর কাছাকাছি অবস্থান করতে লাগলো। তাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি ছিলো ওলীদ বিন মুগীরা এবং তার বাড়িতেই ছিল এর সদর দপ্তর। তাদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক সময় ছিল হজ্জের মওসুম। আরবের বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা দলে দলে তাদের সরদারদের নেতৃত্বে মক্কায় সমবেত হতো। এ সময় রাসূল (সাঃ) ঐ সব দলের সদস্য ও নেতাদের সাথে তাঁবুতে তাঁবুতে গিয়ে সাক্ষাৎ করতেন এবং দাওয়াত দিতেন। প্রতিক্রিয়াশীল নেতিবাচক আন্দোলনের নেতারা তা দেখে তেলে বেগুনে জ্বলতো। একবার হজ্জের মওসম সমাগত হলে কোরায়েশ নেতারা ওলীদের বাড়িতে সমবেত হয়ে কিভাবে এর প্রতিরোধ করা যায় সে জন্য তারা জনগণের মতামত চাইলো। বিভিন্ন গ্র“পের মতামত শোনার পর ওলীদ তার মত ব্যক্ত করলো এবং সে বললোঃ আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদের কথাবর্তা বড়ই মধুর। তাঁর কথার শেকড় অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং তার শাখা-প্রশাখায় অনেক ফল ধরে। এ দাওয়াত বিজয়ী হবেই। একে পরাভূত করা যাবেনা। এ দাওয়াত অন্য সব কিছুকে পর্যুদস্তু করে দেবে। তোমরা যেটাই বলবে, নিরর্থক ও বৃথা হয়ে যাবে। তবে তোমরা যা যা বলেছ, তার মধ্যে মানানসই হলো সে একজন যাদুকর এটাই বলবে। তাঁর কথায় সমাজের বিভেদ ও বিচ্ছেদ ঘটায়। আর সে জন্যই তাঁকে মানুষেরা বয়কট করে রেখেছে। লক্ষ্য করার বিষয়, কিভাবে ইসলামের ধারক-বাহকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। যে কথা বিবেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়না, সে কথাই জোর করে চালু করার চক্রান্ত করা হয়। আধুনিক কালে এসেও আমরা ইসলাম ও এর ধারক বাহকদের বিরুদ্ধে সেই একই ধরণের চিত্র দেখতে পাচ্ছি। ঐ মজলিসেই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, মক্কা অভিমুখী প্রত্যেক রাস্তার মুখে এক একটা দল বসে থাকবে এবং প্রত্যেক প্রতিনিধি দলকে মুহাম্মদ (সাঃ) ও তাঁর দাওয়াত সম্পর্কে সতর্ক করে দেবে। বিরুদ্ধবাদী প্রচারণার এই জোরদার অভিযানের খবরাদি শুনে আবু তালেব শংকিত হন যে, আরবের জনগণ সংঘবদ্ধভাবে বিরোধিতা শুরু করে না দেয়। যদিও তিনি ইসলাম কবুল করেন নী কিন্তু তিনি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কিছু হোক এটা বরদাশত করবেন না, প্রয়োজনে তাঁর পক্ষে জীবন দিতেও প্রস্তুত বলে প্রকাশ্যভাবে জানিয়ে দিলেন। অপরদিকে আবু জাহেল ইসলামের বিপক্ষে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো এবং রাসূল (সাঃ) কে ভীষণ কষ্ট দিত। পরিকল্পনা অনুসারে কাজ এগিয়ে চললো, কিন্তু আশানুরুপ ফল হলো না।

সাহিত্য ও গান বাজনার ফ্রন্ট

মক্কার কাফেরদের সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও যখন এ দাওয়াত সম্প্রসারিত হয়েই চলছিল তখন নযর বিন হারেস কুরাইশ নেতাদেরকে বললো, তোমরা যেভাবে এ ব্যক্তির মোকাবিলা করছো, তাতে কোন কাজ হবে না। এ ব্যক্তি তোমাদের মধ্যেই জীবন যাপন করে শৈশব থেকে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছে। আজ পর্যন্ত নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে সে ছিল তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো, সত্যবাদী, আমানতদার ও বিশ্বস্ত লোক। তোমরাই তাঁকে আল্-আমীন উপাধি দিয়েছিলে। অথচ আজ যখন সে তাঁর দাওয়াত পেশ করলো, অমনি তোমরা বলতে আরম্ভ করলে, সে গণক, যাদুকর, কবি, উম্মাদ, পাগল ইত্যাদি। এ দোষগুলোর মধ্য থেকে কোন্টি মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওপর প্রযোজ্য হয় যে, সেটি বিশ্বাস করার জন্য তোমরা লোকদেরকে আহবান জানাতে পারবে? থামো, এ রোগের চিকিৎসা আমিই করবো। এরপর সে বিভিন্ন দেশ থেকে অনারব রাজা-বাদশাহ্দের কিস্সা কাহিনী এবং রুস্তম ও ইসফিন্দিয়ারের গল্পকথা সংগ্রহ করে এনে গল্প বলার আসর জমিয়ে তুলতে লাগলো। তার উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে লোকেরা কুরআনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং এসব গল্প-কাহিনীর মধ্যে ডুবে যাবে। এজন্যে সে গায়িকা বাঁদীদেরকেও কিনে এনেছিল। কোন ব্যক্তি সম্পর্কে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কথায় প্রভাবিত হতে চলেছে বলে তার কাছে খবর এলেই সে তার জন্য একজন বাঁদী নিযুক্ত করতো এবং তাকে বলে দিতো ওকে খুব ভালো করে পানাহার করাও ও গান শুনাও এবং সবসময় তোমার সাথে জড়িয়ে রেখে ওদিক থেকে ওর মন ফিরিয়ে আনো। সত্যের বিপক্ষে সবসময়ই বড় বড় ধুর্তবাজ অপরাধীরা এ চালবাজীর আশ্রয় নিয়ে তারা জনগণকে খেল-তামাশা ও নাচগানে (কালচার) মশগুল করতে থাকে। এতে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের খানা-পিনার ব্যবস্থাসহ একাজে পারদর্শী লোকদেরকে মোটা অংকের উপঢৌকন দেয়ার ব্যবস্থাও থাকে। এভাবে তাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার প্রতি নজর দেবার চেতনাই থাকে না এবং অস্তিত্ব জগতের মধ্যে তারা একথা অনুভবই করতে পারে না যে, তাদেরকে এক ভয়াবহ ধ্বংসের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইসলামের মূল প্রাণশক্তি হলো আল্লাহর আনুগত্য ও নৈতিকতা। নর-নারীর অবাধ মেলামেশা ও অশ্লীলতার পরিবেশে ঐ প্রাণশক্তির মৃত্যু ঘটে। যে পরিবেশে খাওয়া দাওয়া, গান বাজনা, বিনোদন, ললিত কলা ও যৌনতার প্রতি সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়, সে পরিবেশ ইসলামী দাওয়াতের উপযোগী হতে পারেনা। এ কারণেই নযর বিন হারেস একদিকে বিনোদনমূলক কিচ্ছাকাহিনী পরিবেশন করা শুরু করে আর অপর দিকে গান বাজনা, নারী-পুরুষের সম্মিলন ও অশ্লীলতার সমাবেশ ঘটায়। যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত আছে। তথাকথিত নারীর ক্ষমতায়নের নামে নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা ও অশ্লীলতার প্রসার ঘটানো হচ্ছে। যার ফলে আজ মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। এমন কি কতিপয় মুুসলিম নযর বিন হারেসের সহযোগী হয়ে আল্লাহর পথ থেকে মানুষদেরকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নযর বিন হারেস ও তার দোসররা এ কাজের মাধ্যমে নিজেদের ঘাড়ে কত বড় যুলুমের দায়ভাগ চাপিয়ে নিচ্ছে, তা তারা জানে না। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক সূরা লোকমানের ৬ নং আয়াতে বর্ণনা  করেছেন এভাবে; “মানুষের মধ্যে কেউ কেউ অজ্ঞতাবশতঃ আল্লাহর পথ হতে (মানুষকে) বিচ্যুত করবার জন্যে অসার বাক্য ক্রয় করে নেয় এবং আল্লাহ প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে; তাদেরই জন্যে রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।” আর রাসূল (সাঃ)-এর বাণী হচ্ছে, “যে ব্যক্তি গায়িকা বাঁদীর মাহফিলে বসে তার গান শুনবে, কিয়ামতের দিন তার কানে গরম শীসা ঢেলে দেয়া হবে।” এ শাস্তি তাদের অপরাধের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই নির্ধারিত। তারা আল্লাহর দ্বীন, তাঁর আয়াত ও তাঁর রাসূলকে লাঞ্ছিত করতে চায়। এর বদলায় আল্লাহ তাদেরকে কঠিন লাঞ্ছনাকর আযাব দেবেন। অপরদিকে তারা আল্লাহর দ্বীনকে নিভিয়ে দিতে পারবে না। যেমন পারেনি নযর বিন হারেস ও তার দলবলেরা। নযর বিন হারেসের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর সে কোরায়েশ বুদ্ধিজীবিদের পরামর্শক্রমে মদীনায় ইহুদী ধর্মযাজকদের কাছে গেল ইসলামী আন্দোলনকে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে পরামর্শের জন্যে। আজকের পৃথিবীর মুসলিম মিল্লাত ও সেই ইহুদীদের চক্রান্তের কবলে পড়েছে। সে সময় যেমন ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করা যায়নি, আজও তা প্রতিরোধ করা কারোরই পক্ষে সম্ভব নয়।
আপোষ প্রস্তাব ও প্রলোভন

প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করার পর যখন ইসলামী আন্দোলন দ্রুতগতিতে প্রসার ঘটতে লাগলো এবং পরবর্তীতে যখন অপপ্রচার ও হিংস্রতার বিভিন্ন আয়োজন ব্যর্থ ও নিষ্ফল হয়ে গেল, তখন বিরোধীরা অনুভব করলো যে, ইসলামী আন্দোলন একটা অজেয় শক্তি এবং তা অচিরেই দেশে একটা বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে ছাড়বে। তাই আপোষ মীমাংসা ও সমঝোতার একটা পথ খুঁজে পাওয়ার আশায় তারা আপোষ প্রস্তাবের তৎপরতা শুরু করলো। তাদের একটা প্রস্তাব এই ছিল যে, মুহাম্মদ (সাঃ) তাদের দেবদেবী ও মূর্তিগুলোর নিন্দা সমালোচনা করবেন না এবং তাদের ধর্মে হস্তক্ষেপ করবেন না। এ ছাড়া আর যত ইচ্ছা ওয়ায নছিহত ও নৈতিক উপদেশ দিতে চান, দেবেন, তাতে কোন আপত্তি করা হবে না। অর্থাৎ আল্লাহর নাম নেয়ার অবকাশ থাকবে, কিন্তু আল্লাহ ছাড়া আর কোন মা‘বুদ নেই এ কথা বলা যাবে না। যে বাতিল ধ্যানধারণার ওপর প্রচলিত সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। সমাজে খারাপ পরিবেশ ও খারাপ উপাদান যেটুকু যেভাবে আছে, তাকে ঐভাবেই বহাল থাকতে দিতে হবে। সত্য ও ন্যায়কে এমন আকারে পেশ করতে হবে, যেন তা বিপ্লবের পথ উন্মুক্ত না করে এবং তা থেকে বৈপ্লবিক প্রেরণা নির্মূল করে দিতে হবে। ইসলামের রাজনৈতিক সংলাপ নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে। সমাজ ব্যবস্থাকে যথারীতি বহাল রেখে তার অধীনে আধ্যাত্মিক ধরনের সমাজ সংস্কারের কাজ করে যেতে হবে। ভাবখানা যেন এই কোরাইশদের শ্রেণীগত শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার ও নেতৃত্ব, ধর্মীয় নেতৃত্ব ও কৌলিন্য, কায়েমী স্বার্থ এবং অর্জিত পদমর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা সবই বহাল রাখতে হবে। এরপর তুমি যা করতে চাও, কর। বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদ্বীরা সে ধরনেরই প্রস্তাব নিয়ে ময়দানে নেমেছে। কিন্তু আদর্শবাদ্বী আন্দোলনে এত বেশি শৈথিল্যেও অবকাশ থাকেই-না যে, লেনদেন ও গোজামিলের মাধ্যমে একটা মধ্যবর্তী পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ইসলামী আন্দোলন যদি এ শর্ত মেনে নিত, তবে তা আপনা থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যেত। তাদের অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে ছিলো, এই কুর‘আন বাদ দিয়ে তদস্থলে অন্য কোন কুর‘আন আনতে হবে অথবা তাতে এমন রদবদল করতে হবে, যাতে আমাদের দাবী দাওয়াও পূর্ণ হয় এবং তোমার আশপাশ থেকে সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকগুলোকে বের করে দাও। যারা ইতিপূর্বে আমাদের গোলাম ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে, যে সব তাজা প্রাণ তরুণ সত্য ও ন্যায়ের ঝাণ্ডা তুলে নিয়েছিল, যারা নিজেদের যাবতীয় স্বার্থ কুরবানী করে সব রকমের বিপদমুসিবত হাসিমুখে বরণ করে নিচ্ছিল এবং যাদের প্রতিটি নিঃশ্বাস এ পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের কাজে নিবেদিত ছিল, তাদের উৎসাহ যেন ভেংগে যায় এবং ইসলামী আন্দোলন যেন তাদের একনিষ্ঠ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। রাসূল (সাঃ)-এর মনে এ প্রতারণাপূর্ণ আপোষ প্রস্তাবের কোন প্রভাব পড়ার আগেই কুরআন তাঁকে সতর্ক করে দেয় যে, এটা ইসলামের শক্রদের একটা চিরাচরিত ধাপ্পাবাজী। পূর্ববর্তী সকল নবীর সাথে এই ধাপ্পাবাজীর আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। সূরাহ হুদের ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, হযরত নূহ (আঃ) কেও এধরনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। আন‘আমের ৫২ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, তুমি ইসলামের শক্রদেরকে খুশী করার জন্য সকাল বিকাল আল্লাহর ইবাদতকারী একনিষ্ঠ সাথীদের নিজের সান্নিধ্য থেকে দূরে সরিয়ে দিও না। শুয়ারার ২১৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, তোমার এই সব নিষ্ঠাবান অনুসারীদেরকে স্নেহের সাথে লালন করতে থাক। এমনকি সূরাহ আবাসায় তাঁকে শুধু এজন্য ভর্ৎসনা করা হয়েছে যে, তিনি একজন প্রভাবশালী কাফেরের সাথে কথা বলার সময় নিজের একজন অন্ধ সাহাবীর প্রশ্ন করাকে অপছন্দ করেছিলেন। কুরাইশরা এদিক থেকেও নিরাশ হয়ে অবশেষে তারা উতবা বিন রবিয়ার মাধ্যমে খুব লোভনীয় প্রস্তাব পাঠালো। সে বললোঃ ‘তোমার উদ্দেশ্য যদি ধনসম্পদ অর্জন করা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা তোমার জন্য এত ধনসম্পদ সংগ্রহ করে দেব, যাতে তুমি আমাদের সবার চেয়ে ধনবান হয়ে যাবে।’  আর যদি তুমি নেতৃত্ব ও ক্ষমতা হাতে পেতে চাও, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা ও সরদার নিযুক্ত করতে প্রস্তুত আছি। তুমি যদি দেশের রাজা হতে চাও তাহলে আমরা তোমাকে রাজা বানাতেও প্রস্তুত। আর যদি তোমার ওপর কোন জ্বীনের প্রভাব হয়েছে মনে কর, তাহলে আমরা চাঁদা তুলে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। বাতিলরা শুধু এটুকুই জানে যে, ধন-সম্পদ আর শাসন-কতৃত্ব লাভের উদ্দেশ্যেই মানুষ জান-মাল কুরবানী করে থাকে। তারা কি করে বুঝবে যে, আখেরাতে অনন্ত জীবনের কামিয়াবীর জন্যেও মানুষ এগুলো উৎসর্গ করে থাকে? সব ক‘টা প্রস্তাব শোনার পর রাসূল (সাঃ) সূরাহ হা-মিম সাজদা তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুধু তাওহীদের দাওয়াত এবং তাঁর নবুয়্যতের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানিয়ে দিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর জবাব শুনে উতবা অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে ফিরে গেলো। সে কুরাইশ নেতৃবর্গের সামনে নিজের রিপোর্ট পেশ করতে গিয়ে বললোঃ ‘মুহাম্মদ যে কালাম পেশ করছে, তা কিন্তু কবিত্ব নয়, বরং অন্য কিছু। আমার মতে মুহাম্মদকে তাঁর নিজের ওপরই ছেড়ে দেয়া উচিত। যদি সে সফল হয় তো সমগ্র আরবের ওপরই বিজয়ী হবে এবং তাতে তোমাদেরও ইজ্জত বাড়বে। আর তা না হলে আরব নিজেই তাকে ধ্বংস করে ফেলবে।’ কিন্তু কুরাইশরা তার এ অভিমত সমর্থন করলো না। এরপর একটি কর্মপন্থাই শুধু বাকি রইলো। যা এ পর্যায়ে এসে প্রত্যেক বাতিল শক্তিই হকের বিরুদ্ধে অবলম্বন করে থাকে। তাহলো, পূর্ণ জোর-জবরদস্তি ও নিষ্ঠুরতার সাথে হকের আওয়াজকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রয়াস। তাই কুরাইশরা ফয়সালা করলো যে, মুসলমানরা যাতে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেরাই নিজেদের সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হয, সেজন্যে তাদের ওপর নির্দয় ব্যবহার করতে হবে। তাদের যাকে যেখানে পাওয়া যাবে, সেখানেই নিপীড়ন চালাতে হবে।
তৃতীয় স্তরঃ ঈমানের পরীক্ষা

ইসলামের শত্রুরা চিরকালই উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে অসৎ এবং যুক্তির দিক দিয়ে অসার ও দেউলে হয়ে থাকে। তাদের আসল সমস্যা হয়ে থাকে স্বার্থপরতা ও গদির নেশা। ইসলামের দাওয়াত নিয়ে কেউ ময়দানে নামলেই তারা সর্বশক্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং যুক্তি-প্রমাণের জবাব দেয় সহিংসতা সন্ত্রাস ও গুণ্ডামী দিয়ে। ইসলামী আন্দোলন মানবীয় বিবেক-বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির বলে কাজ করে। কিন্তু ইসলাম বিরোধীরা ক্রোধ ও প্রতিহিংসার আবেগ উত্তেজনা দিয়ে এর গতি রোধে সচেষ্ট হয়। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য কোন শক্তি যদি সামান্যতম তৎপরতাও চালায়, তবে তাকে সমাজ ব্যবস্থার ধারক-বাহকদের হাতে মার খেতে হয়। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত যে সুদূর প্রসারী ও সর্বাত্মক পরিবর্তনের আহবান জানায়, তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রচলিত রাষ্ট্র ও সমাজের কর্ণধাররা এক ধরনের তীব্র উন্মত্ততায় ভোগে। মক্কায় এই অবস্থাটাই দেখা দিয়েছিল। যদিও প্রকাশ্য দাওয়াতের সূচনার সাথে সাথেই সহিংসতাও শুরু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে জাহেলিয়াতের হিংস্রতা ও মুসলিম নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। পাঁচ ছয় বছরের মধ্যেই মক্কায় ইসলাম গ্রহণকারীদের জন্য একটা জ্বলন্ত চুলোয় পরিণত হলো। হযরত খাদীজা ও জনাব আবু তালেবের ইন্তিকালের পর এই চুলোর দহনশক্তি আরো তীব্র ও ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো। কম হোক, বেশি হোক, এই চুলোয় দগ্ধ হওয়া থেকে কেউ রেহাই পায়নি। এই চুলোয় দগ্ধ হয়ে তপ্ত হয়ে ও গলে গলে তাঁরা খাঁটি সোনায় পরিণত হন। এ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের কাজ যেটুকু অগ্রসর হয়েছিলো, তার প্রতিক্রিয়া তিন ভাবে প্রকাশ পেলোঃ
(১) কিছু সৎ ও ভালো লোক ইসলামকে কবুল করলো। তারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ইসলামী আন্দোলনকে যে কোন মূল্যে এগিয়ে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলো।
(২) অজ্ঞতা, ব্যক্তি স্বার্থ কিংবা বাপ-দাদার অনুসৃত ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসহেতু বহু লোক এ আন্দোলনের বিরোধিতার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
(৩) মক্কা ও কুরাইশদের গণ্ডী অতিক্রম করে এ আন্দোলন অপেক্ষাকৃত বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে এই নতুন আন্দোলন এবং পুরনো জাহিলিয়াতের মধ্যে এক কঠিন দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত শুরু হলো। রাসূলসহ (সা.) সাহাবায়ে কেরামের ওপর পরিচালিত হতে লাগলো ভয়ঙ্কর নির্যাতন যার ইতিহাস আমরা খুব কমই জানতে পারি। ইসলামের দুশমনদের পরিচালিত এই নির্যাতনের যৎসামান্য তুলে ধরা হলো। নির্যাতন চালানো হতো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে। ইসলাম গ্রহণকারী যদি ভালো পদমর্যাদাধারী ব্যক্তি হতো তাহলেও তাঁকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করতো এবং বলতো, তুমি তোমার বাপের ধর্ম ত্যাগ করেছ। কাজেই আমরা তোমাকে বেকুফ প্রতিপন্ন করবো, তোমার মতামত যে খারাপ ও ভুল, তা আমরা প্রমাণ করে ছাড়বো, তোমার মান-সম্মান ভূ-লণ্ঠিত করে তবে ক্ষান্ত হবো। আর যদি তিনি ব্যবসায়ী হতেন  তবে তাঁকে বলতো, আমরা তোমার ব্যবসায়ের সর্বনাশ ঘটাবো এবং তোমার মালপত্র নষ্ট করে দেবো। আর যদি দুর্বল কেউ হতো তাহলেতো আর কথাই নেই, নির্যাতনের সীমা ছাড়িয়ে যেত। বস্তুত কুরাইশদের এ পর্যায়ের যুলুম-নিপিড়নের ঘটনাবলী ছিলো খুবই নির্মম ও হৃদয়বিদারক। যেমন, হযরত খাব্বাব (রা.) উম্মে আম্মারের গোলাম ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের কারণে কুরাইশরা তাঁকে মাটির ওপর কয়লা জ্বালিয়ে তার ওপর তাকে চিৎ করে শুইয়ে দিত এবং তিনি যাতে নড়াচড়া করতে না পারেন, সেজন্যে এক ব্যক্তি তাকে পা দিয়ে সজোরে চেপে ধরতো। শেষ পর্যন্ত পিঠের নিচেই জ্বলন্ত কয়লা নিভে ঠাণ্ডা হয়ে যেত। পরবর্তীকালে খাব্বাব (রা.) হযরত ওমর (রা.) কে একবার নিজের পিঠ দেখালে তিনি কুষ্ঠের ন্যায় সাদা সাদা দাগ দেখতে পান।

কৃষ্ণাঙ্গ হযরত বিলাল (রা.) ছিলেন উমাইয়া বিন খালফের ক্রীতদাস। উমাইয়া তাঁকে দুপুরে উত্তপ্ত মরুভূমির বালুর ওপর তাকে শুইয়ে দিতো এবং বুকের ওপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে বলতো, ইসলামকে অস্বীকার কর, নচেত এভাবেই ধুঁকে ধুঁকে মরে যাবি। কিন্তু সেই নিদারূণ কষ্টের মধ্যেও তাঁর মুখে শুধু ‘আহাদ’ ‘আহাদ’ (আল্লাহ এক আল্লাহ এক) শব্দ উচ্চারিত হতো। উমাইয়া তাঁর গলায় রশি বেঁধে শিশু-কিশোরদের হাতে দিতো। ওরা তাঁকে শহরের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে টেনে নিয়ে যেতো।

হযরত ওমর (রা.)-এর পরিবারে লুবানিয়া নামে একজন বাঁদী ছিল। মুসলমান হবার আগে ওমর (রা.) তাঁকে এত মারধোর করতেন যে, তিনি নিজেই ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। কিন্তু এ মুসলিম মহিলা শুধু বলতেন, যদি ইসলাম গ্রহণ না করো তো আল্লাহ তোমার কাছ থেকে এর বদলা গ্রহণ করবেন। মোটকথা পুরুষ ও নারীদের মধ্যে এমন কেউ ছিল না যাকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়নি।  (যার ধারাবাহিকতা আজও চলছে সারা পৃথিবী জুড়ে। তবে সেসময় নির্যাতন করতো কাফিররা, আর আজ তাদের সাথে যোগ দিয়েছে কতিপয় নামধারী মুসলমান। যারা সামনের কাতারে থেকেই নির্যাতনের নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা কি জানে কি আগুন নিয়ে খেলা করছে তারা?)। সে সময়ের  যুলুম-নিপীড়ন একজন মুসলমানকেও ইসলাম ত্যাগে সম্মত করাতে পারেনি। আজও নির্যাতন যতই করা হোক ইসলামের গতিরোধ করা সম্ভব নয়। এইসব বেকসুর ও নিরপরাধ মুসলমানদের ওপর যখন যুলুম-পীড়ন চলছিলো, তখন লোকেরা স্বভাবতই তাদের প্রতি কৌতহলী দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে লাগলো। তারা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো-এত মুসিবত সত্ত্বেও এই লোকগুলো কিসের মোহে ইসলামকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে? কোন্ প্রলোভনের হাতছানি এদেরকে এতখানি কষ্ট-সহিঞ্চু করে তুলেছে? একথা সবাই জানতো যে, নৈতিক চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং মানবীয় গুণাবলীর দিক দিয়ে এরা নিঃসন্দেহে উত্তম মানুষ। এদের অপরাধ শুধু এই যে, এরা  আল্লাহর হুকুম পূর্ণাঙ্গভাবে পালন করতে চায়। অব্যাহত যুলুম-পীড়ন সত্ত্বেও নও-মুসলিমদের এহেন দৃঢ়তাব্যঞ্জক উক্তি অনেক লোকের সামনেই প্রশ্নের সৃষ্টি হলো এবং তাদের হৃদয়-মনে নম্রতার সৃষ্টি হলো। তারা এই নতুন আন্দোলনকে নিকট থেকে দেখবার ও বুঝবার জন্যে আগ্রহান্বিত হলো। সত্যাশ্রয়ী ও ন্যায়নিষ্ঠদের ওপর যুলুম-পীড়ন চিরকালই সত্যের কামিয়াবীর পক্ষে সহায়ক হয়ে থাকে। তাই একদিকে যেমন কুরাইশদের অত্যাচার বেড়ে চলছিলো, অন্যদিকে তেমনি ইসলামী আন্দোলনের পরিধিও সম্প্রসারিত হতে লাগলো। এমনকি গোটা পরিবার বা খান্দানের কোনো একটি লোক ইসলাম কবুল করেনি-মক্কায় এমন কোনো খান্দান বা পরিবারই আর রইলো না। একারণেই তারা ইসলামের বিরুদ্ধে আরো বেশি ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তারা দেখতে লাগলো ; তাদেরই আপন ভাই-ভাতিজা, বোন-ভগ্নিপতি, পুত্র-কন্যা ইসলামের ছায়াতলে সমবেত হচ্ছে এবং ইসলামের জন্যে সবকিছু ত্যাগ করে তাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। তাদের কাছে এটা ছিলো অত্যন্ত কঠিন ও দুঃসহ আঘাতের শামিল। অপরদিকে যারা এ আন্দোলনে যোগ দিলো, তাদের নৈতিক চরিত্র এবং সাধারণ মানবীয় গুণাবলী সবার কাছেই স্পষ্ট ও সুবিদিত ছিলো। এ অবস্থায় সাধারণ লোকেরা হতবাক হয়ে ভাবলোঃ ইসলামী আন্দোলনে এমন কী আকর্ষণ রয়েছে, যা লোকদেরকে এরূপ আত্মোৎসর্গের জন্যে অনুপ্রাণিত করছে? তাছাড়া লোকেরা এ-ও দেখতে লাগলো যে, ইসলামের গণ্ডির মধ্যে প্রবেশ করার পর এসব লোক অধিকতর ন্যায়ানুগ, সত্যবাদী, চরিত্রবান এবং আচার-ব্যবহারে উত্তম ও পুত-পবিত্র মানুষে পরিণত হচ্ছে। ইসলামের আহবানে যে-ই একবার সাড়া দিত, তার ভেতরে সম্পূর্ণ নতুন একটা মানুষ জন্ম নিত এবং তার বুকে নতুন শক্তি সঞ্চারিত হতো। এসব বিষয় প্রতিটি দর্শকের মনে অনির্বচনীয় এক ভাবধারার সঞ্চার করতে লাগলো এবং এর ফলে ইসলামী দাওয়াতকে কবুল করুক আর না-ই করুক, তার শ্রেষ্ঠত্বকে তারা কিছুতেই উপলব্ধি না করে পারলো না।

আবিসিনিয়ায় হিজরত

প্রতিটি বিপদ মুসিবতেরই একটা সহ্য সীমা থাকে। ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহীরা কঠিন অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হচ্ছিল, এবং তাতে তারা ধৈর্যের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, তা অবশ্যই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। কিন্তু যুলুম নির্যাতনের বিরতির কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলনা। বরং ক্রমেই তা জোরদার হচ্ছিল। রাসূল (সাঃ) তাঁর সঙ্গীদের দুরবস্থা দেখে মর্মাহত হতেন। কিন্তু তাঁর কিছুই করার ক্ষমতা ছিলনা। তাদের একমাত্র অবলম্বন ছিল আল্লাহর প্রতি আস্থা, আখেরাতে অবিচল ঈমান, সত্যের চূড়ান্ত বিজয়ের দৃঢ় আশা এবং আবেগভরা দোয়া। রাসূল (সাঃ) তাঁর সাথীদের এই বলে আশ্বাস দিতেন যে, আল্লাহ কোন না কোন পথ অবশ্যই বের করবেন। বাহ্যত মক্কার পরিবেশ হতাশাব্যঞ্জক হয়ে উঠছিল এবং এমন কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না যে, ঐ অনুর্বর ভূমিতে ইসলামী আন্দোলনের পবিত্র বৃক্ষে কোন ফল জন্মাবে। পরিস্থিতি দেখে স্পষ্টতই মনে হচ্ছিল, মক্কায় ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের সম্ভাবনা নেই, এ সৌভাগ্য হয়তো অন্য কোন ভূখন্ডের কপালে লেখা রয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে আগেও হিজরতের অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই অনুমিত হচ্ছিল যে, রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদেরকেও হয়তো মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে হবে। কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট অনুমতি বা নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত দাওয়াতের কেন্দ্রীয় ভূমিকে পরিত্যাগ করা নবীদের নীতি নয়। তা সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) যুলুম ও ধৈর্যের সঙ্ঘাতকে এমন এক পর্যায়ের দিকে ধাবমান হতে দেখছিলেন, যেখানে সহনশীলতার মানবীয় ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। মুসলমানগণ ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছিলেন আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে। এরূপ পরিস্থিতে তিনি সাহাবীদের পরামর্শ দিলেন কিছু মুসলমানকে হিজরত করে আবিসিনিয়ায় যেতে হবে। আবিসিনিয়া আফ্রিকার পূর্ব উপকুলবর্তী একটি দেশ। এখানকার বাদশাহ নাজ্জাশী ছিলেন একজন ন্যায়পরায়ণ ও সুবিচারক খৃষ্টান। এই হিজরতের উদ্দেশ্য ছিলো অবস্থা অনুকুল না হওয়া পর্যন্ত কিছুসংখ্যক মুসলমান অন্তত কুরাইশদের জোর-যুলুম থেকে রেহাই পাবে এবং ইসলামের দাওয়াত দূর এলাকায় বিস্তৃত হবার সুযোগ পাবে। সুতরাং নবুয়তের পঞ্চম বছর রজব মাসে প্রথম দফায় এগারো জন পুরুষ ও চার জন মহিলা হযরত উসমান বিন আফফানের নেতৃত্বে রাতের অন্ধকারে আবিসিনিয়া অভিমুখে রওনা হলেন। হযরত উসমানের সাথে তাঁর মহীয়সী স্ত্রী, রাসূল (সঃ)-এর কন্যা রুকাইয়াও হিজরতের এই প্রথম সফরে সঙ্গিনী হন। এই কাফেলার গৃহত্যাগের খবর যখন কোরাইশরা জানতে পারলো, তৎখণাত তারা তাদের পিছু ধাওয়া করতে লোক পাঠালো। কিন্তু তারা জেদ্দা বন্দরে পৌঁছে জানতে পারলো, তাৎক্ষণিকভাবে নৌকা পেয়ে যাওয়ায় তারা এখন নাগালের বাইরে। এরপর আরেকটা বড় কাফেলা আবিসিনিয়ায় হিজরত করলো। এ কাফেলায় ৮৫ জন পুরুষ ও ১৭ জন মহিলা ছিল। আবিসিনিয়ায় তারা নিরাপদ পরিবেশ পেলেন এবং নিশ্চিন্তে ইসলামী জীবন যাপন করতে লাগলেন। এ খবর কুরাইশদের কাছে পৌঁছলে তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, আবিসিনিয়ায় লোক পাঠিয়ে মুসলমানদের ফিরত আনার জন্য বাদশাহ নাজ্জাশীকে বলতে হবে যে, এ লোকগুলো আমাদের দেশ থেকে পলাতক অপরাধী, এদেরকে আপনার দেশ থেকে বের করে দিন। আব্দুল্লাহ বিন রাবিয়া ও আমর বিন আসকে এ কাজের জন্যে মনোনীত করলো। তারা নাজ্জাশীর দরবারে গিয়ে বললো এরা আমাদের দেশ থেকে পলাতক অপরাধী; এদেরকে আমাদের হাতে প্রত্যর্পণ করুন। এবার লক্ষ্য করুন, ইসলামের শক্রুদের আক্রোশ কত সুদূরপ্রসারী হয়ে থাকে।



মুহাজিরদের ফিরিয়ে আনার জন্য আবিসিনিয়ায় কুরাইশদের দূত প্রেরণ:

আবিসিনিয়ায় মুসলমানরা বেশ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে লাগলেন। কিন্তু কুরাইশদের তা মোটেই ভালো লাগলোনা। তারা সিদ্ধান্ত নিলো যে, নাজ্জাশীর নিকট দু‘জন যোগ্য দূত পাঠাবে, সাথে দেয়া হবে বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তারা আবদুল্লাহ বিন রাবিয়া ও আমর বিন আসকে বিপুল পরিমাণ উপঢৌকন দিয়ে পাঠালো এবং তাদের করণীয় কাজ তাদেরকে বুঝিয়ে দিলো। তারা তাদেরকে বুঝিয়ে দিলো, “মুহাজিরদের’ সম্পর্কে নাজ্জাশীর সাথে কথা বলার আগে তোমরা প্রত্যেক দরবারী, উপদেষ্টা ও রাজ কর্মচারীকে উপঢৌকন দেবে। অতঃপর নাজ্জাশীকে উপঢৌকন দিয়ে অনুরোধ করবে, তিনি যেন “মুহাজির’দেরকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করেন এবং সমর্পণ করার আগে নাজ্জাশী যেন মুহাজিরদের সাথে কোন কথা না বলেন সে দিকে খেয়াল রাখবে। এ উদ্দেশ্যেই উপঢৌকন (ঘুষ) ও গোপন যোগসাজশের পথ অবলম্বন করা হয়। কারণ, মুসলমানদের সাথে কথা বললে তাদের প্রতি তিনি সদয় হবেন এবং আমাদের অবস্থা জেনে ফেলবেন।” তারা অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে রওয়ানা করলো এবং নাজ্জাশীর দরবারে এসে উপস্থিত হলো। নাজ্জাশীর সাথে কথাবার্তা বলার আগে তারা নাজ্জাশীর প্রতিটি উপদেষ্টা, দরবারী ও রাজ কর্মচারীদের সাথে আঁতাত করে তাদের উপঢৌকন (ঘুষ) দিলো। (এটা ছিলো বিবেক ধোলাইর একটা কৌশল, যা আজও প্রয়োগ করা হচ্ছে মুসলিম দেশ গুলোর এক শ্রেণীর উপদেষ্টা, আমলা, মন্ত্রী ও সুশীলদের (?)ক্ষেত্রে। বিদেশীরা মগজ ধোলাইর মাধ্যমে এ সকল চাটুকারদের দ্বারা দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে)। উপঢৌকন দেয়ার পর তাদের প্রত্যেককে তারা বললো “ আমাদের দেশ থেকে কতগুলো বেকুব যুবক বাদশাহর রাজ্যে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা নিজ জাতির ধর্ম ত্যাগ করেছে অথচ আপনাদের ধর্মও গ্রহণ করেনি। তারা এক নতুন উদ্ভট ধর্ম তৈরী করেছে। সে ধর্ম আপনাদের ও আমাদের কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। জাতির সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত লোকেরা আমাদেরকে বাদশাহর কাছে পাঠিয়েছেন যেন তিনি ওদেরকে ওদের স্ব জাতির কাছে ফেরত পাঠান। আমরা যখন বাদশাহর সাথে কথা বলবো তখন আপনারা বাদশাহকে ওদের ফেরত পাঠাতে ও ওদের সাথে কোন কথা না বলতে পরামর্শ দেবেন। কেননা তাদের দোষত্র“টি সম্পর্কে তাদের জাতিই সবচেয়ে ভাল জানে। তারা চেষ্টা চালিয়েছিল যাতে দরবারে পুরো ঘটনা নিয়ে আলোচনাই না হতে পারে, মুহাজেররা আদৌ কথা বলারই সুযোগ না পায় এবং রাজা কুরাইশ দূত দ্বয়ের এক তরফা কথা শুনেই যেন মুহাজিরদেরকে তাদের হাতে সমর্পণ করে। দরবারীরা সবাই এতে সম্মতি জানালো। এরপর তারা নাজ্জাশীকে উপঢৌকন দিয়ে তাদের দাবী-দাওয়া পেশ করলো। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজদরবারীরাও তাদের দাবীর প্রতি সমর্থন জানালো। কিন্তু এতে নাজ্জাশী ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি বললেন, “না, এ পরিস্থিতিতে আমি তাদেরকে এই দূত দ্বয়ের হাতে সমর্পণ করবো না। এক দল লোক আমার দেশে অতিথি হয়েছে। তারা অন্য কোথাও না গিয়ে আমার কাছে আসাকে ভাল মনে করেছে। তাই আমি মুসলমানদের বক্তব্য শুনে ভাল-মন্দ বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত দিবো। তিনি মুসলমানদের সাথে কথা বলতে চাইলেন।
মুসলমানরা নিজেদের পক্ষ থেকে কথা বলার জন্যে জাফর বিন আবু তালেবকে মনোনীত করলেন। বাদশাহ তার দরবারে ধর্মযাজকদের ইঞ্জিল খুলে বসতে বললেন। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন,“তোমাদের সেই ধর্মটা কি যা গ্রহণ করে তোমরা নিজ জাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছ এবং আমার ধর্ম বা অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করনি।?” মুসলমানদের মুখপাত্র হিসাবে জাফর বিন আবু তালেব উঠে দাঁড়ালেন এবং নাজ্জাশীর কাছে এই মর্মে আবেদন জানালেন যে, প্রথমে তাকে মক্কার দূতদ্বয়ের কাছে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে অনুমতি দেয়া হোক। নাজ্জাশীর অনুমতি লাভের পর তিনি নিম্নরূপ প্রশ্ন করলেনঃ
জা‘ফরঃ আমরা কি মক্কায় কারো ক্রীতদাস ছিলাম যে, আমরা আমাদের মনিবের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি? তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে তো আমাদের অবশ্যই ফেরত পাঠানো উচিত।

আমর ইবনুল আসঃ না, তোমরা ক্রীতদাস নও, স্বাধীন ও সম্ভ্রান্ত।

জাফরঃ আমরা কি কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে এসেছি? যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে আমাদেরকে অবশ্যই নিহত
ব্যক্তির উত্তরাধিকারী বা অভিভাবকদের কাছে ফেরত পাঠানো উচিত।

আমর ইবনুল আসঃ না, তোমরা এক ফোঁটা রক্তও প্রবাহিত করনি।

জাফরঃ আমরা কি কারো ধনসম্পদ চুরি করে এসেছি? তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সেই পাওনা পরিশোধ করতে প্রস্তুত।
আমর ইবনুল আসঃ না, তোমাদের কাছে কারো এক পয়সাও পাওনা নেই।

এই জেরার মাধ্যমে যখন মুসলমানদের নৈতিক অবস্থা ও মান সুস্পষ্ট হয়ে গেল, তখন জাফর তাঁর ভাষণ দেয়া শুরু করলেন। তিনি দরবারে যে ভাষণ দেন, তার বিস্তারিত বিবরণ ইতিহাস গ্রন্থসমূহে সংরক্ষিত রয়েছে। তার থেকে সামান্য তুলে ধরা হলোঃ জাফর বিন আবু তালেব বললেন, “ হে বাদশাহ ! আমরা ছিলাম অজ্ঞ জাতি। অন্ধকার ও বিভ্রান্তির মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। আমরা এক আল্লাহর পরিবর্তে মানুষের গড়া অসংখ্য মূর্তির পূজা করতাম। মরা জীব-জন্তুর গোশত খেতাম: ব্যভিচার, লুটতরাজ, চৌর্যবৃত্তি, পারস্পারিক জুলুম, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদি ছিলো আমাদের দৈনন্দিন কাজের অন্তর্ভুক্ত। আমাদের শক্তিমানরা দুর্বলদের শোষণ করতে গর্ববোধ করতো। মোটকথা, জীব-জন্তুর চেয়েও আমাদের জীবনযাত্রা ছিলো নিম্ন পর্যায়ের। কিন্তু আল্লাহর রহমত দেখুন, তিনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করে আমাদেরই ভিতরকার এক ব্যক্তিকে রাসূল নিযুক্ত করে পাঠিয়েছেন। আমরা তাঁর বংশ-খান্দানকে খুব ভালো করে জানি। তাঁর ব্যক্তিগত অবস্থার সঙ্গেও পরিচিত। তিনি অত্যন্ত ভালো লোক এবং সত্যবাদী, আমানতদার, ও সচ্চরিত্রবান। দোস্ত, দুশমন সবাই তাঁর সততা ও ভদ্রতার প্রশংসা করে। তিনি আমাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছেন এবং এই শিক্ষা দিয়েছেনঃ “তোমরা মূর্তিপূজা ছেড়ে দাও; এক আল্লাহকে নিজের মালিক ও মনিব বলে স্বীকার করে; জীবনের সকল কাজে তাঁরই বন্দেগী করো; সত্য কথা বলো, হত্যা ও খুন-খারাবী থেকে বিরত থাকো। এতীমের মাল খেয়ো না, পাড়াপড়োশীর সাহায্য করো, ব্যভিচার ও অন্যান্য অশ্লীল ক্রিয়াকর্ম থেকে বেঁচে থাকো। নামাজ পড়তে ও যাকাত দিতে বললেন। এভাবে জাফর একে একে ইসলামের বিধানগুলো তুলে ধরলেন। এরপর বললেন, আমরা তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি, শির্ক ও মূর্তিপূজা ছেড়ে দিয়েছি এবং সমস্ত অসৎ কাজ থেকে তাওবা করেছি। এরফলে আমাদের কওম আমাদের শত্র“ হয়ে গেল, তারা আমাদের ওপর জুলুম নির্যাতন দ্বারা আমাদের জীবন দুর্বিসহ করে তুললো এবং আমাদেরকে সেই পূর্বের পথে ফিরিয়ে নেয়ার চাপ দিতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের ঈমান ও জান বাঁচানোর জন্য আপনার দেশে পালিয়ে এসেছি। আমাদের আশা এই যে, আপনার কাছে অত্যাচারের শিকার হবো না।” নাজ্জাশী বললেন, “ বেশ, তোমাদের নবীর ওপর আল্লাহর যে কালাম নাযিল হয়েছে, তার কিছু অংশ পড়ে শোনাও।” জাফর বিন আবু তালেব সূরায়ে মারইয়ামের কতিপয় আয়াত পড়ে শোনালেন। নাজ্জাশী আয়াত গুলো শুনে অত্যন্ত প্রভাবিত হলেন। তাঁর চোখ বেয়ে পানি ঝরে দাড়ি ভিজে গেল। তাঁর সাথে সাথে ধর্মযাজকরাও কাঁদতে কাঁদতে ইঞ্জিল কিতাব ভিজিয়ে ফেললেন। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললেন, “আল্লাহর কসম, এই কালাম আর ইঞ্জিল কিতাব একই উৎস থেকে এসেছে। মুহাম্মদ তো সেই রসূলই, যার ভবিষ্যদ্বাণী হযরত ঈসা আ. করেছিলেন। আল্লাহর শোকর যে, আমি সেই রসূলের যুগটা পেয়ে গেলাম। সাথে সাথে তিনি এই ঘোষণা দিলেন, হে কুরাইশ দূতদ্বয়, তোমাদের হাতে মুসলমানদের,ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। ওরা এখানেই থাকবে।”

হযরত উমরের ইসলাম গহণ

রাসূল সা. যখন নবুয়্যত লাভ করেন, তখন উমরের বয়স ছিল সাতাশ বছর। ইসলাম গ্রহণের আগে উমর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের কঠোরতম দুশমনদের অন্যতম। ইসলাম খুব দ্রুত গতিতে তাঁর পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর ভগ্নীপতি সাঈদ প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর বোন ফাতেমাও মুসলমান হয়ে যান। উমরের (রাঃ) পরিবারের আরো এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব নঈম বিন আবদুল্লাহও ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেন। প্রথমে তিনি জানতেই পারেননি যে, তাঁর পরিবারে এভাবে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে। কুরাইশরা একদিকে ইসলামী আন্দোলন ও তাঁর আহবায়কের বিরোধিতায় চরম পন্থা অবলম্বন করতে লাগলো, অন্যদিকে এদের সঠিক পথ-নির্দেশনার জন্যে মুহাম্মাদ সা.-এর হৃদয়- মন আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। আবু জেহেল এবং উমর উভয়েই তাঁর দুশমনীতে অত্যন্ত কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করেছিলো। দাওয়াত ও তাবলীগের কোন প্রচেষ্টাই তাদের ওপর কার্যকর হচ্ছিলো না। তাই একদিন অল্লাহর কাছে তিনি দোয়া করলেনঃ “প্রভু হে, আবু জেহেল এবং উমর-এ দু‘জনের মধ্যে যে তোমার কাছে বেশি প্রিয়, তাকে তুমি ইসলামের দ্বারা সম্মানিত করো।” উমর (রাঃ) বর্ণনা করেছেনঃ “জাহেলিয়াতের যুগে খুব বেশি পরিমাণে মদ খেতাম। মক্কার একটি বাজারে (হাযওয়ারাতে) আমাদের মদের আসর বসতো এবং সেখানে কুরায়শী বন্ধুরা জমায়েত হতো। এক রাতে আমি নিজের সতীর্থদের আকর্ষণে ঐ আসরে উপস্থিত হই। সতীর্থদের কাউকে সেখানে না পেয়ে চলে গেলাম কা‘বা শরীফে। সেখানে গিয়ে দেখলাম রাসূল সা. নামাজ পড়ছেন। সহসা মনে ইচ্ছা জাগলো, লোকটা কি পড়ে একটু শোনা যাক। কা‘বার গেলাফের ভিতরে ঢুকে আস্তে আস্তে একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি সূরায়ে আল- হাক্কাহ থেকে পড়ছিলেন। আমি কালাম শুনে বিস্ময়-বিমুগ্ধ হলাম। মনে মনে ভাবলামঃ অল্লাহর কসম ! লোকটি নিশ্চয়ই কবি। ঠিক সে মূহূর্তে তিনি এ আয়াত পড়লেনঃ “এ এক সম্মানিত বার্তাবাহকের কালাম,এ কোনো কবির বাণী নয়; (কিন্তু) তোমাদের মধ্যে খুব কম লোকই ঈমান এনে থাকে।” এ কথা শোনামাত্রই আমার ধারণা হলোঃ ‘লোকটি তো আমার মনের কথা জেনে ফেলেছে। এ নিশ্চয় কোনো গণক হবে।’ এরপরই তেলাওয়াত করলেনঃ “এ কোনো গণকের কালাম নয়, তোমরা খুব কমই নসিহত পেয়ে থাকো। এতো রাব্বুল আলামীনের কাছ থেকে নাযিল হয়েছে।” তিনি এ সূরা শেষ পর্যন্ত পড়লেন। আমি অনুভব করলাম, ইসলাম আমার হৃদয়ে তার আসন তৈরি করে নিচ্ছে। কিন্তু হযরত উমর অত্যন্ত শক্ত প্রকৃতির ও দৃঢ়চিত্ত লোক ছিলেন। এজন্যে এবারই তাঁর ভিতরকার পরিবর্তনটা পূর্ণ হলো না। তিনি তাঁর চিরাচরিত পথেই চলতে লাগলেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, এ সময় আবু জাহেল রাসূল (সা.) কে যে হত্যা করতে পারবে তাকে দু‘শো উট পুরস্কার দেয়ার কথা ঘোষণা করলো এবং সে পুরস্কার পাওয়ার জন্যে উমর তলোয়ার নিয়ে মুহাম্মদ (সা.) কে হত্যার জন্য ঘর থেকে বের হলেন। কিন্তু উমরের মেজাজের সাথে তার এ ধরনের লোভের শিকার হওয়াটা বেমানান। যাই হোক, তিনি তলোয়ার হাতে রওয়ানা দিলেন। পথিমধ্যে নঈম বিন আবদুল্লাহর সাথে সাক্ষাত হওয়ায় বাধা গ্রস্ত হলেন। নঈম বললেন, ‘আগে তোমার নিজের ঘরে খোঁজ নাও, তারপর যেখানে যেতে চাও যেয়ো।’ উমর তৎক্ষণাত সোজা বোনের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন। তাঁর বোন- ভগ্নীপতি উভয়ই তখন কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। উমরকে আসতে দেখেই তাঁরা চুপ হয়ে গেলেন এবং কুরআনের অংশটি লুকিয়ে ফেললেন। উমর ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলেন, কী পড়ছিলে? তোমরা নাকি বাপ-দাদার ধর্মকে ত্যাগ করেছো? একথা বলেই তিনি ভগ্নিপতিকে প্রহার করতে লাগলেন। স্বামীর সাহায্যে বোন এগিয়ে এলে তাঁকেও তিনি পিটাতে লাগলেন। তাঁরা উভয়েই রক্তাক্ত হয়ে গেল। অশ্রুভরা চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে বোন বললেন, ‘ উমর ! যা ইচ্ছে করতে পার। কিন্তু আমাদের পক্ষে ইসলাম ত্যাগ করা সম্ভব নয়।” ক্ষতবিক্ষত দেহ, রক্তাক্ত পোশাক, চোখভরা অশ্রু ও আবেগ ভরা মন নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে সহোদর বোনের মুখে এমন তেজদীপ্ত কথা শুনে উমর প্রভাবিত হলেন। এমন মর্মস্পর্শী দৃশ্যের সামনে কে ধৈর্য ধরতে পারে! উমরের দুর্ধর্ষ শক্তিও হার মানলো। তিনি বললেন, “ তোমরা কি পড়ছিলে আমাকে শোনাও দেখি।” ফাতেমা গিয়ে কুরআনের লুকিয়ে রাখা পাতাগুলো নিয়ে এলেন। তেলাওয়াত করতে করতে যখন এ আয়াত পর্যন্ত এসে পৌঁছলেনঃ “ আমি অল্লাহ, আমি ছাড়া আর কোনো মা‘বুদ নেই; সুতরাং আমারই ইবাদত করো এবং আমার স্মরণের জন্যে নামাজ পড়ো।” অমনি স্বতঃস্ফুর্তভাবে ঘোষণা করলেনঃ লা-ইলাহা ইল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ।” ঈমান আনার পর ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্র হযরত আরকামের বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হলেন। উমর দরজার নিকট পৌঁছলে তাঁর হাতে তরবারী দেখে উপস্থিত সাহাবিগণ ঘাবড়ে গেলেন। কিন্তু হামযা (রা.) বললেন, “ আসুক না, তাঁর নিয়্যাত যদি ভালো হয় তো ভালো কথা। নচেত তার তরবারী দ্বারাই তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলবো।”উমর ঘরের মধ্যে পা বাড়াতেই মুহাম্মাদ (সা.) এগিয়ে এসে তাঁকে সজোরে আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “ কি উমর, কি উদ্দেশ্য এসেছো?”একথা শুনেই যেন উমর ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি অত্যন্ত বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন, “ঈমান আনার উদ্দেশ্যে।” মুহাম্মাদ সা. স্বতঃস্ফুর্তভাবে বলে উঠলেন, “ আল্লাহু আকবার।” সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সাহাবী তকবীর ধ্বনি উচ্চারণ করলেন। উমর (রা.) এর ঈমান আনার পর থেকেই কা‘বা ঘরে সর্ব প্রথম প্রকাশ্যে জামায়াতে নামায পড়া শুরু হলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘ আমরা হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের আগে কা‘বায় প্রকাশ্যে নামায পড়তে পারতাম না। উমর ইসলাম গ্রহণ করলে তিনি কুরাইশদের সাথে লড়াই করে কা‘বায় নামায পড়লেন এবং আমরাও তাঁর সাথে নামায পড়লাম। উমর (রা.) মক্কার যুবকদের মধ্যে স্বীয় মেধা ও আবেগ উদ্দীপনার জন্য বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাঁর আচার ব্যবহার ছিল আন্তরিকতা ও নিষ্ঠায় পরিপূর্ণ। জাহেলিয়াতের যুগে তিনি ইসলামের সাথে যে শত্রুতা পোষণ করতেন, তাও কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা তাড়িত হয়ে নয় বরং তাঁকে ন্যায় সংগত মনে করে আন্তরিকতার সাথেই করতেন। তারপর যখন প্রকৃত সত্য তাঁর কাছে উদঘাটিত হলো এবং বিবেকের ওপর থেকে পর্দা সরে গেল, তখন পূর্ণ নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে ইসলামের পতাকা উচুঁ করে তুলে ধরলেন। তীব্র সহিংসতার ভিতর দিয়েও শত্রুদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিবর্গ এভাবেই ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে।

জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বন্দী জীবন

ইসলামী আন্দোলনের ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতি দেখে ইসলামের শত্রুরা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে। তারা ইসলামের আলো নিভিয়ে দেবার জন্যে নিত্য-নতুন ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের সকল ফন্দি ফিকিরের ব্যর্থতা, ইসলামের অগ্রগতি ও বড় বড় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ইসলাম গ্রহণের দৃশ্য দেখে দিশাহরা হয়ে উঠে। নবুয়্যতের সপ্তম বছরে মক্কার সব গোত্র ঐক্যবদ্ধ হয়ে বনু হাশেম গোত্রকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে বয়কট করার চুক্তি সম্পাদন করলো এবং তা কা‘বার দেয়ালে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। চুক্তিতে স্থির করা হলো যে, বনু হাশেম যতক্ষণ মুহাম্মদ (সা.) কে আমাদের হাতে সমর্পন না করবে এবং তাকে হত্যা করার অধিকার না দিবে, ততক্ষণ কেউ তাদের সাথে মেলা-মেশা, বেচা-কেনা, বিয়ে শাদী, লেনদেন, কোন খাদ্য ও পানীয় দ্রব্য সরবরাহ করতে পারবেনা। এবার বনী হাশিমের সামনে মাত্র দু‘টি পথই খোলা রইলোঃ হয় মুহাম্মদ (সা.) কে কাফিরদের হাতে সমর্পন করতে হবে, নচেত সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কটের ফলে বন্দী জীবনের দুঃখ- মুসিবত সহ্য করার জন্যে তৈরি হতে হবে। গোত্রীয় ব্যবস্থায় এ সিদ্ধান্তটা ছিলো অত্যন্ত মারাত্মক এবং চূড়ান্ত পদক্ষেপ। সমগ্র বনু হাশিম অসহায় অবস্থায় শেষক্ত ধারা মেনে নিয়ে ‘শিয়াবে আবু তালেব’ উপত্যকায় আটক হয়ে গেল। এ গিরি-দূর্গের মধ্যে মুহাম্মদ (সা.) সহ বনু হাশিমকে দীর্ঘ তিন বছরকাল মহা দূর্গতির মধ্যে মানবেতর জীবন কাটাতে হলো। এসময় কখনো কখনো তাঁদের গাছের পাতা ও শুকনো চামড়া পর্যন্ত খেতে হতো। যখন ক্ষুধার জ্বালায় নিষ্পাপ শিশুরা চিৎকার করতো, তখন কুরাইশরা আনন্দে ঊল্লাস করতো। কখনো কোন হৃদয়বান ব্যক্তির মনে করুণার উদ্রেক হলে হয়তো লুকিয়ে তিনি কিছু খাবার পাঠিয়ে দিতেন। সমগ্র বনু হাশিম গোত্র একমাত্র ইসলামী আন্দোলনের নেতা মুহাম্মদ (সা.)-এর কারণে এই করুন পরিস্থিতির শিকার হলো। এভাবে ক্রমাগত তিন বছরকাল বনু হাশিম গোত্র ধৈর্যের অগ্নি- পরীক্ষা প্রদান করলো। অতঃপর আল্লাহ তা‘য়ালা জালিমদের হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার করলেন। একের পর এক কুরাইশদের মন নরম হতে লাগলো এবং তাদের পক্ষ থেকেই চুক্তি বাতিলের আন্দোলন শুরু হলো। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হলো। লোকেরা যখন চুক্তিটাকে কা‘বার প্রাচীর থেকে নামালো তখন অবাক হয়ে দেখলো যে, সমগ্র চুক্তিটাকে উই পোকায় খেয়ে ফেলেছে। কেবল ‘বিইসমিকা আল্লাহুম্মা’ (আল্লাহর নামে লেখা হলো) কথাটি বাকী আছে। আবু জাহেল এবং তার কিছু অনুসারী বিরোধীতা করেছিলো; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ হলো। নবুয়্যতের দশম বছর মুহাম্মাদ (সা.) সহ বনু হাশিম গোত্র বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করলেন।
চতুর্থ স্তরঃ ঈমানের অগ্নী পরীক্ষা

বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করলেন ঠিকই কিন্তু এবার তার চেয়েও কঠিন যুগের সূচনা হলো। যে শেষ আশ্রয়টি এ যাবত পরম স্নেহে রাসূল সা. কে শত্রুদের কবল থেকে রক্ষা করে আসছিল এবং কোন চাপ ও উস্কানীর কাছে নতি স্বীকার না করে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সকল চক্রান্ত প্রতিহত করে আসছিল, সে আশ্রয়টি হারিয়ে গেল। অর্থাৎ চাচা আবু তালেব ইন্তেকাল করলেন। এর কিছু দিন পরই খাদীজা রা.ইন্তেকাল করলেন। যিনি শুধু স্ত্রী-ই ছিলেন না, ওহী নাযিলের আগ থেকে শুরু করে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সত্যের পথে রাসূল সা.এর যথার্থ জীবন সংগিনীর ভূমিকা পালন করে গেছেন। ইসলাম প্রসারের জন্য তিনি প্রচুর অর্থও ব্যয় করেছেন। পদে পদে পরাপর্শও দিয়েছেন এবং আন্তরিকতা সহকারে সহযোগিতাও করেছেন। এই বাহ্যিক দু’টি শক্তি হারিয়ে যাওয়ায় বিরোধিতা আরো প্রচন্ড আকার ধারণ করলো। এবার বিরোধিতা ও নির্যাতন নিপীড়ন অতীতের সমস্ত রেকর্ড যেন ছাড়িয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু অল্লাহর ইচ্ছা সম্ভবত এই ছিল যে, ইসলাম নিজের হেফাজত নিজেই করুক, নিজের চলার পথ নিজেই তৈরী করুক এবং নিজের পায় দাড়াতে শিখুক। দুনিয়াবী সহায়গুলো এভাবে হটিয়ে না দিলে হয়তো সত্যের প্রাণশক্তি পুরোপুরি দৃশ্যমান হতে পারতোনা। এখন কুরাইশরা চরম অসভ্য আচরণ শুরু করে দিল। বখাটে ছেলেদেরকে তাঁর পেছনে লেলিয়ে দিতে লাগলো। রাসূল সা. যখন নামায পড়তেন, তখন হাতে তালি দিত। পথে চলার সময় তাঁর ওপর নোংরা বর্জ্য নিক্ষেপ করা হতো। দরজার সামনে কাঁটা বিছানো হতো। কখনো তাঁর গলায় ফাঁস লাগানো হতো। কখনো তাঁর গায়ে পর্যন্ত হাত দেয়া হতো, প্রকাশ্যে গালাগালি করতো। মুখের ওপর মাটি ও থুথু নিক্ষেপ করতো। একবার আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল রাসূল সা. কে হত্যার উদ্দেশ্যে হাতে পাথর নিয়ে হারাম শরীফে ঢুকে পড়লো। রাসূল সা. হারাম শরীফে তার সামনেই ছিলেন। কিন্তু অল্লাহ তাঁকে হেফাজত করলেন, উম্মে জামিল তাঁকে দেখতেই পেলনা। অগত্যা সে ক্রোধ উদগীরণ করে কবিতা আবৃত্তি করলো “ আমরা নিন্দিত ব্যক্তির আনুগত্য প্রত্যখ্যান করেছি, তার আদেশ অমান্য করেছি এবং তার ধর্মের প্রতি শক্রতা পোষণ করেছি।” বস্তুত নাম বিকৃত করা এবং খারাপ শব্দ প্রয়োগ করা নৈতিক নীচতা ও অধোপতনের লক্ষণ। শত্রু যখন ইতরামির সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়, তখন এই সব নোংরা অস্ত্র প্রয়োগ করে থাকে। অনুরূপভাবে একবার আবু জাহল পাথর দিয়ে আঘাত করে রাসূল সা. কে হত্যা করার মতলবে তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। কিন্তু অল্লাহ আবু জাহলকে সহসাই এমন ভীত ও সন্ত্রস্থ করে দেন যে, সে কিছুই করতে পারেনি। একবার শত্রুরা সদলবলে রাসূল সা. এর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এই মর্মান্তিক ঘঁটনার বর্ণনায় আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আ‘স বলেন যে, রাসূল সা.এর ওপর কুরাইশদের পক্ষ থেকে এমন বাড়াবাড়ি আর কখনো দেখিনি। এই দুঃখজনক ও দুঃসহ পরিস্থিতির কারণেই এ বছরটা দুঃখের বছর নামে আখ্যায়িত হয়। রাসূল সা.শুধু এতটুকুই বল্লেন যে, যে যুলুম নির্যাতনের ছুরি তোমরা আমার উপর চালাচ্ছো, ইতিহাসের শ্বাশত বিধান আল্লাহর আইন শেষ পর্যন্ত তোমাদের এই যুলুমের রাজত্ব একেবারেই খতম হয়ে যাবে। আর আল্লাহ অবশ্যই তাঁর দ্বীনের ধারক-বাহকদের সাহায্য করে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করবেন।

তায়েফে হৃদয়বিদারক ঘটনা

মক্কার পরিবেশ দিন দিন খারাবের দিকেই যাচ্ছিল। চাচা আবু তালেবের মৃত্যুর পর রাসূল সা. মক্কায় বাহ্যত একেবারেই সহায়হীন ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিলেন। এখন কুরাইশরা মুসলমান ও মুহাম্মাদ সা.এর প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে উৎপীড়ন চালাতে শুরু করলো। তাইএবার তিনি মক্কার বাহিরে অল্লাহর বাণী প্রচার করার ফয়সালা করলেন। যায়েদ বিন হারেসাকে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে রওনা দেন। পথিমধ্যে যে সব গোত্রের বসতবাড়ী দেখতে পান তাদের সবার কাছে আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দেন। আসা যাওয়ায় তাঁর প্রায় এক মাস সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। তায়েফের অধিবাসীরা ছিল খুবই স্বচ্ছল, সুখী এবং অত্যধিক ভোগবিলাস ও আরাম আয়েশে মত্ত। আর্থিক সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের অধিকারী হলে মানুষ সাধারণত আল্লাহকে ভুলে যায় এবং প্রবৃত্তির লালসা চরিতার্থ করার কাজে নিয়োজিত হয়। এর ফলে তায়েফবাসীরা ছিলো বেপরেরায়া ধরনের। অপর দিকে সুদখোরীর কারণে তাদের মানবতাবোধ সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গিয়েছিলো। এদিক থেকে তায়েফ ছিলো মক্কার চেয়েও খারাপ জায়গা। প্রথমে তিনি তায়েফ গমন করে তায়েফের বড় বড় বিত্তবান ও প্রভাবশালী লোকদের ইসলামের দাওয়াত দিলেন। কিন্তু সম্পদ ও ক্ষমতা যেমন প্রায়শই সত্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, এখানেও ঠিক তা-ই হলো। রাসূল সা.এর দাওয়াত প্রথ্যাখ্যান করে জনৈক তায়েফ সর্দার বিদ্রুপ করে বললো, ‘আল্লাহ কি তাঁর রাসূল বানাবার জন্যে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পাননি? সত্যিই যদি আল্লাহ তোমাকে পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনি কা‘বা ঘরের গেলাফের অবমাননা করতে চান।’ আর এক জন বললো, ‘কী আশ্চর্য! আল্লাহ তাঁর রাসূল বানানোর জন্য তোমাকে ছাড়া আর কোন উপযুক্ত লোক পেলেন না!’ তৃতীয় জন বললো, ‘আমি তোমার সাথে কথাই বলতে পারিনা। কারণ, তুমি যদি সত্যবাদী হও তো তোমার সঙ্গে কথা বলা আদবের খেলাফ। আর যদি মিথ্যাবাদী (নায়ুজুবিল্লাহ) হও তাহলে তো তোমার সাথে কথা বলা যায় এমন যোগ্যতাই তোমার নেই।’ প্রতিটি কথা রাসূল সা.এর বুকে বিষমাখা তীরের মত বিদ্ধ হতে লাগলো। তিনি পরম ধৈর্য সহকারে মর্মঘাতী কথাগুলো শুনলেন। এর পর তারা শহরের সবচেয়ে নিকৃষ্ট বখাটে তরুণ, চাকর-নকরদেরকে রাসূলের পেছনে লেলিয়ে দিল এবং বলে দিল যে, যাও, এই লোকটাকে লোকালয় থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এসো।’ বখাটে যুবকদের এক বিরাট দল আগে পিছে গালি দিতে দিতে, হৈ চৈ করতে করতে ও পাথর ছুঁড়ে মারতে মারতে চলতে লাগলো। তারা তাঁর হাঁটু লক্ষ্য করে পাথর মারতে লাগলো, যাতে তিনি বেশী ব্যথা পান। পাথরের আঘাতে আঘাতে এক একবার তিনি অচল হয়ে বসে পড়ছিলেন। কিন্তু তায়েফের গুন্ডারা তার বাহু টেনে ধরে দাঁড় করাচ্ছিল আর পুনরায় হাঁটুতে পাথর মেরে হাতে তালি দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল। ক্ষতস্থান গুলো থেকে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছিল। এভাবে জুতার ভেতর ও বাহির রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল। তবুও জালিমরা অবিরাম তাঁর প্রতি পাথর নিক্ষেপ ও গালি- গালাজ বর্ষণ করতে থাকে। নির্যতনের চোটে অবসন্ন ও সংজ্ঞাহীন হয়ে যাওয়ার পর যিনি রাসূল সা. কে ঘাড়ে করে শহরের বাইরে একটি আঙ্গুরের বাগানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেই যায়েদ বিন হারেসা ব্যথিত হৃদয় বললেন, ‘ধাপনি এদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে বদদোয়া করেন।’ রাসূল সা. বললেন,“আামি ওদের বিরুদ্ধে কেন বদদোয়া করবো? ওরা যদি আল্লাহর ওপর ঈমান নাও আনে, তবে আশা করা যায়, তাদের পরবর্তী বংশধর অবশ্যই আল্লাহর ইবাদত করবে।” এই সফরকালেই জিবরীল এসে বললেন, ‘পাহাড় সমূহের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতারা আপনার কাছে উপস্থিত। আপনি ইংগিত করলেই তারা ঐ পাহাড় দুটোকে এক সাথে যুক্ত করে দেবে, যার মাঝখানে মক্কা ও তায়েফ অবস্থিত। এতে উভয় শহর পিষ্ট ও ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু মানবতার দরদী মহান নবী এতে সম্মত হননি।

আঙ্গুরের বাগানে আশ্রয়কালে হুঁশ আসার পর দু‘রাকাত নামায পড়ে তিনি আল্লহর দরবারে দোয়া করলেনঃ ‘হে আমার রব! আমি আমার দুর্বলতা, সম্বলহীনতা ও জনগণের সামনে অসহায়ত্ব সম্পর্কে কেবল তোমারই কাছে ফরিয়াদ জানাই। দরিদ্র ও অক্ষমদের প্রতিপালক তুমিই। তুমিই আমার মালিক। তুমি আমাকে কার কাছে সঁপে দিতে চাইছ? আমার প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে, নাকি শত্রুর কাছে? তবে তুমি যদি আমার ওপর অসন্তুষ্ট না থাক, তাহলে আমি কোন কিছুর পরোয়া করিনা। কিন্তু তোমার পক্ষ থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা পেলে সেটাই আমার জন্য অধিকতর প্রশস্ত। আমি তোমার আযাবে পতিত হওয়ার আশংকা থেকে তোমার সেই জ্যোতি ও সৌন্দর্য্যরে আশ্রয় কামনা করি, যার কল্যাণে সকল অন্ধকার দূরীভূত এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তোমার সন্তোষ ছাড়া আমি আর কিছু কামনা করিনা। তোমার কাছে ছাড়া আর কোথাও থেকে কোন শক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।”এহেন নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির পর তিনি দাওয়াত দানের উদ্দেশ্যে ‘উকাজ’ নামক এলাকার দিকে যাচ্ছিলেন। পথে ‘নাখলা’ নামক স্থানে যাত্রা বিরতি করেন এবং সেখানে ফজরের নামাযে তিনি কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন। এমনি সময় জ্বিনদের একটি দল ঐ দিক দিয়ে যাচ্ছিলো। তারা মুহাম্মদ সা.এর কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায় এবং তারা সাথে সাথে ঈমান আনে যা সূরা আহকাফ-এ বর্ণিত হয়েছে। এঘটনার কথা পরবর্তীতে আল্লাহ পাক সূরা জ্বিন নাযিল করে রাসূল সা.কে জানিয়ে দেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা. কে জানিয়ে দিলেন যে, মানুষেরা যদি ইসলামের দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে আমার সৃষ্টি জগতে এমন বহু জীব আছে, যারা আপনার সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
জ্বিনদের হাকীকত

তায়েফের মর্মান্তিক ঘটনার পর রাসূল সা. মক্কাভিমুখে রওয়ানা দিলেন। ফেরার পথে তিনি ‘নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থান করে শেষ রাতে ফজরের নামায শুরু করেন। ইয়ামানের নছীবাইন শহরের জ্বিনদের এক প্রতিনিধি দলও তখন সে জায়গা অতিক্রম করছিলো। তারা কুরআন পাঠ শুনে থমকে দাঁড়ালো। খুব মনযোগ সহকারে কুরআন পাঠ শুনলো এবং মুসলমান হয়ে তারা স্বজাতির কাছে ফিরে গিয়ে ঘটনা বর্ণনা করলো। এ ঘটনা সূরা আহকাফ- এ এভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ “স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জ্বিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনতেছিল, যখন তারা তার (নবীর) নিকট উপস্থিত হলো, তারা একে অপরকে বলতে লাগলোঃ , চুপ করে শ্রবণ কর। অতঃপর যখন কুরআন পাঠ সমাপ্ত হলো, তখন তারা তাদের স¤প্রদায়ের কাছে সতর্ককারীরূপে ফিরে গেল। তারা বলেছিলঃ হে আমাদের স¤প্রদায়! আমরা এমন এক কিতাবের পাঠ শুনেছি, যা অবতীর্ণ হয়েছে মুসা (আঃ)-এর পরে। এটা ওর পূর্ববতীঁ কিতাবের সত্যায়ন করে, এবং সত্যধর্ম ও সরল পথের দিকে পরিচালিত করে। হে আমাদের স¤প্রদায়! তোমরা আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দাও এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর। তিনি তোমাদের গোনাহ মার্জনা করবেন। কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া না দেয়, তবে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না। এ ধরনের লোকেরাই প্রকাশ্য পথ ভ্রষ্টতায় লিপ্ত।” রাসূল (সাঃ) এর নবুওয়ত লাভের পর থেকে জ্বিন জাতিকে আকাশের সংবাদ সংগ্রহ থেকে নিবৃত্ত রাখা হয়। সে মতে তাদের কেউ সংবাদ শোনার জন্যে উপরে গেলে তাকে উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করে বিতাড়িত করা হত। জ্বিনরা এই নতুন পরিস্থিতির কারণ উদঘাটনে সচেষ্ট হল এবং তাদের বিভিন্ন দল কারণ অনুসন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ল। রাসূল (সাঃ) সেদিন ‘বাতনে নাখলা’ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। তিনি যখন ফজরের নামাযে কুরআন পাঠ করছিলেন, তখন জ্বিনদের অনুসন্ধানী দলটি সেখানে গিয়ে পৌঁছল। তারা কুরআন পাঠ শুনে বলতে লাগল, এই সে নতুন ঘটনা, যার কারণে আমাদেরকে আকাশের সংবাদ সংগ্রহে নিবৃত্ত করা হয়েছে। জ্বিনেরা পরস্পর বলতে লাগল, চুপ করে কুরআন শুন। রাসূল (সাঃ) নামায শেষ করলেন জ্বিনরা ইসলামের সত্যতায় বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের স¤প্রদায়ের কাছে ফিরে গেল এবং তদন্তকাজের রিপোর্ট পেশ করে একথাও বলল, আমরা মুসলমান হয়ে গেছি। তোমাদেরও ইসলাম গ্রহণ করা উচিত। রাসূল (সাঃ) সূরা জ্বিন অবতীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এই জ্বিনদের গমনাগমন এবং তাদের কুরআন পাঠ শুনে ইসলাম গ্রহণের বিষয় কিছুই জানতেন না। পরবর্তীতে আল্লাহ পাক সূরা জ্বিন নাযিল করে তাঁকে এ বিষয় অবহিত করেন। সূরা জ্বিন-এ এর বিস্তারিত বিবরণ উল্লেখিত হয়েছে। মক্কার কাফেরদের গর্ব অহংকার সেই সাথে ইসলাম গ্রহণ না করে রাসূল (সাঃ) এর প্রতি যে জুলুম করা হয়েছে তার ব্যর্থতা বুঝানোর উদ্দেশ্যে জ্বিনদের ইসলাম গ্রহণের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। জ্বিনরা অহংকার ও গর্বে মানুষের চেয়েও বেশি, কিন্তু কুরআনের বাণী শুনে তাদের অন্তরও বিগলিত হয়ে গেছে এবং ইসলাম গ্রহণ করছে। অপর দিকে তোমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা জ্বিনদের চেয়েও বেশি জ্ঞান-বুদ্ধি ও চেতনা দান করেছেন; কিন্তু তোমরা ইসলাম গ্রহণ করছ না।

আল্লাহ তা‘আলার অসংখ্য সৃষ্টির মধ্যে জ্বিনও একটি বিশেষ সৃষ্টি। জ্বিনদের শরীরী, আত্মাধারী ও মানুষের ন্যায় জ্ঞান এবং চেতনাশীল সৃষ্টজীব। তারা মানুষের দৃষ্টি গোচর নয়। এ কারণেই তাদেরকে জ্বিন বলা হয়। মানবসৃষ্টির প্রধান উপকরণ যেমন মাটি, তেমনি জ্বিন সৃষ্টির প্রধান উপকরণ অগ্নি। এই জাতির মধ্যেও মানুষের ন্যায় নর ও নারী আছে এবং সন্তান প্রজননের ধারা বিদ্যমান আছে। মানুষের ন্যায় জ্বিনদেরও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা আছে। এই কারণে তাদের প্রতিও আল্লাহর দেয়া বিধান সমানভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহর ঘোষণা “আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানুষ ও জ্বিন জাতি সৃষ্টি করেছি।” (সূরা যারিয়াত ৫৬) আর এ কারণে তাদের মধ্যেও ভালো-মন্দ দু‘টি শ্রেণী আছে। পবিত্র কুরআনুল কারীমে যাদেরকে শয়তান বলা হয়েছে, বাহ্যতঃ তারাও জ্বিনদের দুষ্ট শ্রেণীর নাম। জ্বিন ও ফেরেশতাদের অস্তিত্ব কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। এটা অস্বীকার করা কুফরী। অথচ বর্তমান যুগের বহু লোক এ ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত আছে যে, জ্বিন বলতে বাস্তবে কিছু নেই। বরং এটি প্রাচীন কালের কুসংস্কার ভিত্তিক বাজে একটি ধারণা। কোন প্রমাণ ছাড়াই তারা ধরে নিয়েছে যে, গোটা বিশ্ব-জাহানে শুধু তা-ই বাস্তব যা অনুভব করা যায় বা ধরা ছোঁয়ার মধ্যে আনা যায়। যে ব্যক্তি মনে করে যে, যা অনুভব করা যায় না তার কোন অস্তিত্ব নেই, আর যার অস্তিত্ব আছে তা অবশ্যই অনুভ‚ত হবে, সে আসলে নিজের বুদ্ধি-বিবেকের সংকীর্ণতারই প্রমাণ দেয়। এ ধরনের চিন্তাধারা অবলম্বন করলে শুধু জ্বিন নয় বরং এমন কোন সত্যকেই মানুষ মেনে নিতে পারবে না যা সরাসরি তার অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে না এবং অনুভব করা যায় না। অবস্থা যদি এমনই হয় তাহলে সত্যকে মেনে নেয়া তো দূরের কথা আল্লাহর অস্তিত্ব পর্যন্ত তাদের মেনে নেয়া সংশয় দেখা দিতে পারে। মুসলমানদের মধ্যে যারা এরূপ ধ্যান-ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে কিন্তু কুরআনকেও অস্বীকার করতে পারেনি তারা জ্বিন, ইবলীস এবং শয়তান সম্পর্কে কুরআনের ¯পষ্ট বক্তব্যকে নানা রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের বিষয়ে পরিণত করেছে। কুরআনুল কারীমে এক জায়গায় নয় বহু জায়গায় জ্বিন ও মনুষের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা থেকে বুঝা যায় যে, এরা স্বতন্ত্র একটি জাতি। আবার জ্বিনদের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকে মানব সমাজে নানারূপ আজগুবি ধারণাও চালু রয়েছে। আরবেও জ্বিন সম্পর্কে বিশেষ মতবাদ গড়ে উঠেছিলো। মূর্খ লোকেরা তাদের পূজা করতো, তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতো। তাদের ধারণা ছিল জ্বিনরা গায়েবী বিষয়ের খবর জানে। সাধারণ ওঝা শ্রেণীর লোকেরা তাদের সাথে বন্ধুত্বের দাবি করতো। অসংখ্য দেব-দেবির জ্বিনদেরকেও আল্লাহর ব্যাপারে শরীকদার মনে করতো। যদিও জ্বিনদের কিছু অস্বাভাবিক আচরণের ক্ষমতা আল্লাহ পাক দিয়েছেন কিন্তু মানুষ জ্বিনদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মাখলুক। যেমন, মানুষের চেয়ে পশুরা কিছু শক্তির অধিকারী। কিন্তু এর দ্বারা প্রমাণিত হয়না যে, পশুরা মানুষের চেয়ে অধিক মর্যাদার অধিকারী। ইসলাম এসে এসব ভ্রান্ত আকীদাহ-বিশ্বাস বাতিল বলে ঘোষণা করেছে এবং আকীদাহ-বিশ্বাস সংশোধন করে দিয়েছে। ইসলামের স্পষ্ট ঘোষণা হলো জ্বিন আল্লাহর সৃষ্টি। আল্লাহর ব্যাপারে তাদের বিন্দুমাত্র দখল নেই। সে আপন ক্ষমতাবলে না পারে কারো উপকার করতে আর না পারে কারো ক্ষতি করতে। মানুষের ন্যায় জ্বিনদের প্রতিও আল্লাহর ইবাদত করা ফরজ করা হয়েছে। তাদের মধ্যেও আল্লাহর অনুগত ও অবাধ্য এ দু‘টি শ্রেণী রয়েছে। তারাও মানুষের ন্যায় নিজ নিজ আমলের পুরস্কার বা শাস্তি লাভ করবে। আল্লাহর কুদরতের সামনে তারাও একটি অক্ষম ও অসহায় জীবন মাত্র। রাসূল (সাঃ) এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ দ্বীন জমিনে পাঠিয়েছেন। এ দ্বীনের আনুগত্য যেমন মানুষের জন্যে, তেমনি জ্বিনদের জন্যেও বাধ্যতামূলক।
মক্কার বাইরে ইসলামের আলো

ইসলামের আলো যেমন আরবের বিভিন্ন দূর এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছিলো, তেমনি সে আওয়াজ মদীনায় গিয়েও উপনীত হলো। মদীনায় তখন বেশ কিছু ইহুদী জনবসতি ছিলো। তারা বহু প্রাচীনকাল থেকে সেখানে এসে বসবাস করতো। তারা মদীনার আশপাশে ছোট ছোট দুর্গ বানিয়ে নিয়েছিলো। এছাড়াও সেখানে ছিলো বড় বড় দু’টি গোত্র। আওস ও খাজরাজ নামে মদীনায় দুই ভাই ছিলো। এদের আদি নিবাস ছিলো ইয়ামেন; কোন এক সময় মদীনায় এসে বসবাস শুরু করে। এদেরই সন্তান-সন্ততি থেকে সেখানে ‘আাওস’ ও ‘খাজরাজ’ নামে দু‘টি বড়ো খান্দান গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে এরাই ‘আনসার’ উপাধিতে ভূষিত হয়। ধর্ম-বিশ্বাসের দিক দিয়ে এরাও মূর্তিপূজক ছিলো, কিন্তু ইহুদীদের সাথে মেলামেশার ফলে অহী, নবুয়্যত, আসমানী কিতাব এবং আখিরাত সম্পর্কিত আকীদা-বিশ্বাসের সঙ্গেও অনেকটা পরিচিত ছিলো। যেহেতু এদের নিজেদের কাছেই এ ধরনের কোনো জিনিস বর্তমান ছিলো না, এজন্যে ধর্মীয় ব্যাপারে এরা কিছুটা প্রভাবিত ছিলো। তাদের কথার ওপর এরা যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করতো। এরা ইহুদী আলেমদের কাছ থেকে এ-ও জানতে পেরেছিলো যে, দুনিয়ায় আরো একজন পয়গম্বর আসবেন। যারা তাঁর অনুসরণ করবে, তারাই সফলকাম হবে। এমনকি এ নবীর অনুসারীরাই সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। হজ্ব উপলক্ষে মক্কায় আগত গোত্র প্রধানদের কাছে গমন করে তাদেরকে ইসলামে শামিল হবার আহবান জানানো রাসূল (সাঃ)-এর একটা নিয়ম ছিলো। নবুয়্যতের দশম বছরের কোন এক সময়ে রাসূল (সাঃ) মক্কার দূরবর্তী এলাকা ‘আকাবা’ নামক স্থানে খাজরাজ বংশের কতিপয় লোকের কাছে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন এবং তাদেরকে কুরআন মাজীদের কিছু আয়াত পড়ে শোনান। কুরআনের বাণী শুনে তারা প্রভাবিত হলো এবং বুঝতে পারলো: ইহুদী আলেমরা যে নবী আসার কথা বলে থাকে, ইনিই সেই নবী। তারা একে অপরের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, “ আল্লাহর শপথ, ইনিই তো সেই নবী যাঁর কথা বলে ইহুদীরা আমাদেরকে হুমকি দেয় ও শাসায়। এখন ইহুদীদেরকে কিছুতেই আমাদের আগে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে না।” এ চিন্তা করেই তারা ইসলাম কবুল করলো। তারা বললো, “আমরা আশা করি আল্লাহ আমাদের গোটা সম্প্রদায়কেই আপনার সমর্থক করে দিবেন। আমরা তাদের কাছে ফিরে গিয়ে আপনার দাওয়াত তাদের কাছেও পৌঁছে দিবো। আজ যে, জীবন ব্যবস্থাকে আমরা গ্রহণ করলাম সেটা তাদের কাছেও তুলে ধরবো। আল্লাহ যদি তাদেরকে আপনার সমর্থক বানিয়ে দেন তা হলে আপনার চেয়ে সম্মানিত আর কেউ থাকবে না।” এভাবে তারা ঈমান আনা ও ইসলামকে সত্য বলে মেনে নেয়ার পর নিজ এলাকায় ফিরে গেলেন। মদীনায় পৌঁছে তাঁরা রাসূল (সাঃ)-এর বক্তব্য, গোত্রের কাছে পেশ করলেন এবং তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানালেন। আর এভাবেই মদীনায় ইসলামের আলো প্রবেশ করলো। এদের দলে মোট ছয়জন সদস্য ছিলো। এভাবে মদীনার আনসারদের মধ্যে ইসলামের সূচনা হলো এবং সে জনপদটিই পরবর্তীকালে ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রভূমিতে পরিণত হয়েছিলো।
বিরোধিতার তীব্রতা

যে কোন আন্দোলনের বিস্তৃতির সাথে সাথে বিরোধিতা এবং দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতও স্বভাবত বাড়তে থাকে, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের বিস্তৃতির সঙ্গে বিরোধিতা ও দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতের যে প্রচন্ডতা দেখা দেয়, তা তার অনুসারীদেরকে অধিকতর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেয়। দশম নববী সাল পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলন যেমন ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করছিল, তেমনি সত্যের আহবায়ক এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদেরকে কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কুরাইশ প্রধানগণ চূড়ান্তভাবে স্থির করলো যে, তারা খোদ মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর ওপর এতোটা উৎপীড়ন চালাবে, যাতে তিনি নিজেই বাধ্য হয়ে ইসলাম প্রচার থেকে বিরত হন। কুরাইশদের বড়ো বড়ো নেতারা ছিলো তাঁর প্রতিবেশী এবং এরাই ছিলো তাঁর সবচেয়ে বড় দুশমন। এরা যে কায়দায় তীব্রবিরোধীতা আর নির্যাতন করতো তার বর্ণনা পূর্বের কিছু অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা অশালীন ভাষায় গালি-গালাজ করতো। কোথাও তিনি বক্তৃতা শুরু করলে সভার মাঝখানে তারা গোলযোগের সৃষ্টি করতো এবং বলতো, এ সবই মিথ্যা কথা। মোটকথা, হয়রানি ও উৎপীড়নের যতো ন্যাক্কারজনক পন্থা ছিলো, তা সবই তারা ব্যবহার করছিলো। এ পর্যায়ে সকল প্রতিকুলতার মোকাবেলার জন্যে আল্লাহ তা‘য়ালা প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা মূলক অহী নাযিল করছিলেন। মুসলমানদের স্পষ্ট ভাষায় জানানো হলো যে, বর্তমানে সত্যের ওপর দৃশ্যত যে জুলুমের পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে, তাকে কোন স্থায়ী ব্যাপার মনে করা উচিত নয়। দুনিয়ার জীবনে সত্যের পথে এ ধরনের বিপদ এসেই থাকে। তাছাড়া সফলতার আসল ক্ষেত্র এ দুনিয়ার জীবনে নয়, বরং পরকালীন জীবনে। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, যারা তাকওয়ার জীবন অবলম্বন করে, পরকাল তাদের জন্যেই উত্তম। আর রাসূল (সাঃ)-কে বলা হলো “আমি জানি তোমার সাথে যা কিছু করা হচ্ছে তা খুবই বেদনাদায়ক। এরূপ ব্যবহার পূর্বের নবী রাসূলদের সাথেও করা হয়েছে। তাঁরা ধৈর্য ও সংযমের সাথে পরিস্থিতির মোকাবালা করেছেন এবং আমার সাহায্য না পৌঁছা পর্যন্ত সব দুঃখ-মুছিবত হাসিমুখে সহ্য করেছেন। তুমিও এমনি পরিস্থিতি অতিক্রম করছো।” সাহাবায়ে কিরামকে বার বার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, হক ও বাতিলের দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘য়ালার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে, যাকে বদলে দেয়ার সাধ্য কারো নেই। ঈমানের দাবী পুরনে কে সত্য আর কে অপারগ সেটা যাচাই করে সবাইকে দেখিয়ে দেয়াই আল্লাহর এ কৌশল। সে নিয়ম অনুসারে হকপন্থীদেরকে এক সুদীর্ঘকালব্যাপী যাচাই করা এবং তাদের ধৈর্য, সততা, আত্মত্যাগ, আনুগত্য, আত্মসমর্পণ ও ঈমানী দৃঢ়তার পরীক্ষা নেয়া একান্ত অপরিহার্য। সেই সাথে আল্লাহর প্রতি নির্ভরতা এবং তাঁর প্রতি ঈমানের ব্যাপারে তারা কতখানি মজবুত তা-ও নিরূপণ করা প্রয়োজন। কারণ এরূপ দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের মাধ্যমে তাদের মধ্যে এমন সব গুণাবলীর সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীকালে আল্লাহর দ্বীনের খাঁটি অনুবর্তী হবার পক্ষে অত্যন্ত সহায়ক হয়ে থাকে। আর লোকেরা যখন এরূপ পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্য প্রতিপন্ন হয়, কেবল তখনই আল্লাহর সাহায্যে বিজয় আসে।

আকাবার প্রথম বাই‘য়াত

বাই‘য়াত (শপথ, অঙ্গীকার) ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। সাহাবায়ে কেরাম রাসূল (সাঃ)-এর নিকট বাই‘য়াত হয়েছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম আবু বকর সিদ্দীক রাঃ এর নিকট বাই‘য়াত হয়েছেন। মুসলমানদের সামষ্টিক জীবনের পরিচালনার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত হয়েছে তার নিকট বাই‘য়াত হওয়ার এ পদ্ধতি ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং বিষয়টি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবুয়্যতের একাদ্বশ বছর মদীনার বারোজন অধিবাসী আকাবা নামক স্থানে রাসূল (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হলেন। তারা রাসূল (সাঃ)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ পূর্বক অনৈসলামিক কার্যকলাপ পরিত্যাগ করার উদ্দেশ্যে রাসূলের হাতে হাত দিয়ে আনুগত্যের (বাই‘য়াত) অঙ্গীকার করলেন। উবাদা ইবনে ছামিত (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে অঙ্গীকার করেছিলাম যে, “আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবো না, চুরী-ডাকাতি করবো না, ব্যভিচার করবো না, সন্তান হত্যা করবো না, কারো বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ (গীবত) রটাবো না এবং রাসূল (সাঃ)-এর দেয়া ন্যায় সঙ্গত আদেশ কখনো অমান্য করবো না।” রাসূল (সাঃ) বললেন, “এসব অঙ্গীকার পূরণ করলে তোমাদের জন্য রয়েছে জান্নাত।” মদীনার এই দলটি যখন নিজ সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গেল, তখন রাসূল (সাঃ) তাদের সাথে মুসয়াব ইবনে উমায়েরকে পাঠিয়ে দিলেন তাদেরকে কুরআন পড়ানো, ইসলাম শিক্ষা দেয়া ও ইসলামী বিধানের তত্ত্ব বুঝিয়ে দেয়ার জন্য। তিনি মদীনার শিক্ষক রূপে অভিহিত হতেন। তিনি মদীনার ঘরে ঘরে গিয়ে লোকদেরকে কুরআন পড়ে শোনাতেন এবং ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। এভাবে দু-একজন করে লোক ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলো। ক্রমান্বয়ে মদীনার বাইরেও ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

আকাবার দ্বিতীয় বাইয়া‘ত

নবুয়্যাতের তেরতম বছর হজ্জ উপলক্ষে মদীনা থেকে বাহাত্তর মতান্তরে তিহাত্তর জন অধিবাসী মক্কায় এলেন। যাদের মধ্যে দু‘জন মহিলাও ছিলেন। তারা আইয়ামে তাশরিকের মাঝামাঝি সময়ে অন্য সঙ্গীদের থেকে লুকিয়ে আকাবায় গিয়ে মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর হাতে ইসলাম কবুল করলেন এবং যে-কোন অবস্থায় রাসূল (সাঃ)-এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত, মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি, অংশীবাদীদের পতন ঘটিয়ে আল্লাহর দ্বীন বিজয়ী করার জন্যে বাইয়াত (শপথ) সম্পন্ন করলেন। এই লোকগুলো যখন শপথ গ্রহণ করছিলেন, তখন সা‘দ বিন জারারাহ (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন: “ভাইসব! তোমরা কি জানো, কোন কথার ওপর তোমরা শপথ গ্রহণ করছো? জেনে রাখো, এ হচ্ছে গোটা আরব ও অনারবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।” সকলে সমস্বরে বললো, “হ্যা” আমরা সব কিছু বুঝে-শুনেই শপথ গ্রহণ করছি।” ঠিক এই সময়েই মদীনার এই নও-মুসলিম এবং মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মধ্যে স্থিরকৃত হয় যে, কোন সময় যদি মুহাম্মাদ (সাঃ) মদীনায় গমন করেন তো মদীনাবাসীরা সর্বতোভাবে তাঁর সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। এই দলটির মধ্য থেকে বারো ব্যক্তিকে নকীব বা আহবায়ক নিযুক্ত করা হলো, যাতে তারা নিজ নিজ গোত্রের লোকদের এই বাইয়াতে শামিল করে নিতে পারেন। এদের মধ্যে সর্ব প্রথম রাসূল (সাঃ)-এর হাতে বাইয়াত কারী বারা ইবনে মা‘রূর (রাঃ) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ)-এর সাথে আমাদের এই বাইয়াত অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে শয়তান আকাবার পর্বত শীর্ষ থেকে এমন জোরে চিৎকার করে উঠলো যে, ওরকম বিকট চিৎকার আমি আর কখনো শুনিনি। সে চিৎকার করে বলছিলো, “হে মিনাবাসী ! মুজাম্মাম অর্থাৎ নিন্দিত ব্যক্তির সাথে সাবী অর্থাৎ ধর্মদ্রোহীরা যে যোগ সাজস করলো তা কি তোমরা লক্ষ্য করলে না? ওরা তোমাদের সাথে যুদ্ধের পাঁয়তারা করছে।” রাসূল (সাঃ) বললেন, “এ হলো আকাবার শয়তান আযেব ইবনে উযাইবের চিৎকার।” মুজাম্মাম অর্থ ধিকৃত বা নিন্দিত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নাম মুহাম্মাদ অর্থ প্রশংসিতর বিপরিত শব্দ। মুশরিকরা তাঁকে এই নামে ডাকতো। আর যারা ইসলাম গ্রহণ করতো তাদেরকে বলতো সাবি অর্থাৎ ধর্মত্যাগী বা বে-দ্বীন। শয়তানের এ আওয়াজ পৌঁছে গেল কুরাইশদের কানে। সকালেই তারা ঘিরে ফেললো মদীনাবাসীদের। তারা হুংকার দিয়ে বললো আমরা জানতে পেরেছি যে, তোমরা মুহাম্মাদকে নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র করছো। মদীনাবাসীদের মধ্যে মুশরিকরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো “এ ধরনের কোন ষড়যন্ত্রই এখানে হয়নি এবং আমরা তেমন কিছু ঘটেছে বলে জানিনা।” অতঃপর আওস ও খাজরাজ গোত্রের লোকদের সন্ধানে তারা চারিদিকে বেরিয়ে পড়লো। মক্কার নিকটবর্তী আযাখের নামক স্থানে সা‘দ বিন উবাদা (রাঃ) কে তারা ধরে ফেললো এবং উটের রশি দিয়ে বাঁধলো। তারপর তাঁকে পিটাতে পিটাতে চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে মক্কায় নিয়ে গেল। অমানুষিক নির্যাতন শুরু হলো ধারাবাহিকভাবে। সা‘দ (রাঃ) মক্কার কুরাইশদেরকে বাণিজ্যের জন্য মদীনার ওপর দিয়ে যাতায়াতের সময় সহযোগিতা করতেন। অথচ আজ তারাই তাঁকে নির্মম নির্যাতন করছে বিনা অপরাধে। ওদের নজরে অপরাধ সে ইসলামকে বিজয়ী করার শপথ করেছে। (আজো পৃথিবীর যে কোন প্রান্ত থেকেই ইসলামকে বিজয়ী করার জন্য আওয়াজ তোলা হয়, সেখানেই আড়াল থেকে শয়তানের তোলা উষ্কানী ও বিভ্রান্তী মূলক আওয়াজের সাথে সূর মিলিয়ে এক শ্রেণীর মানুষ শয়তান, একই ধরনের আওয়াজ তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করার মাধ্যমে ইসলামের বিজয় প্রতিহত করার উদ্দ্যেশ্যে তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে অবিরাম।)

মু‘জিজা
মু‘জিজা কথাটির সাধারণ অর্থ কোনো অলৌকিক বা অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু ইসলামের পরিভাষায় মু‘জিজা হচ্ছে এক প্রকারের চূড়ান্ত দলীল। কোন পয়গম্বরের নবুয়্যাতের দাবিকে প্রমাণ করার জন্যে আল্লাহ তা‘য়ালা চূড়ান্ত পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে এই দলীলকে উপস্থাপন করেন। অবশ্য তার জন্যে শর্ত এই যে, দলীলের বিষয়বস্তুকে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম হতে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়ঃ আগুনের কাজ হচ্ছে দাহ করা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা দাহ করবে না; সমুদ্রের ধর্ম হচ্ছে প্রবাহিত হওয়া, কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রবাহ থেমে যাবে; বৃক্ষের স্বভাব হচ্ছে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে সে চলমান হবে। অনুরূপভাবে মৃত জীবিত হয়ে উঠবে, লাঠি সাপে পরিণত হবে ইত্যাদি। যেহেতু দুনিয়ার প্রত্যেকটি কাজের আসল কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘য়ালার মহিমা এবং তাঁর ইচ্ছা মাত্র, সেহেতু কোনো কোনো কাজ যেমন নির্ধারিত নিয়মে ক্রমাগত সস্পন্ন হতে থাকে, ঠিক তেমনি কোনো কোনো কাজ আল্লাহ তা‘য়ালারই মহিমায় এই স্বাভাবিক নিয়ম থেকে বিচ্যুত হয়ে কোনো অস্বাভাবিক নিয়মেও হতে পারে। আর যখন আল্লাহর ইচ্ছা হয়, তখন তা হয়েও থাকে। অল্লাহ তা‘য়ালা অধিকাংশ নবীকেই তাঁদের নবুয়্যাতের সত্যতা প্রমাণের জন্যে মু‘জিজার ক্ষমতা দান করেছিলেন। কিন্তু সে মু‘জিজা কাফিরদের ঈমান আনা ও বিশ্বাস পোষণের কারণ হিসেবে খুব কমই কাজ করেছে। আগেই বলা হয়েছে, মু‘জিজা হচ্ছে এক প্রকারের চূড়ান্ত দলীল। এজন্যে লোকেরা যখন মু‘জিজা দেখার পরও নবীকে অস্বীকার করেছে, তখন তাদের ওপর আল্লাহ তা‘য়ালা গজব নাযিল করেছেন এবং দুনিয়া থেকে তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। মক্কার কুরাইশরাও মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর কাছে মু‘জিজা দাবি করছিলো। তাদের এই দাবিকে বার বার এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। কারণ আল্লাহ তা‘য়ালার নিয়মানুযায়ী কোনো জনগোষ্ঠীকে তাদের দাবি অনুসারে যদি কোন মু‘জিজা দেখানো হয়, তাহলে তারপর তাদের সামনে শুধু দু‘টি পথই খোলা থাকেঃ ঈমান অথবা ধ্বংস। কুরাইশদেরকে ধ্বংস করে দেয়ার কোনো ইচ্ছা আল্লাহ তা‘য়ালার ছিলো না। সেজন্য তাদের দাবিকেও বার বার এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। কিন্তু ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে করতে যখন দীর্ঘ দশ-এগারটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো এবং লোকদেরকে বুঝানোর কাজও প্রায় শেষ হয়ে এলো তখন মুহাম্মাদ (সাঃ) এবং অন্যান্য মু‘মিনদের মনের মাঝে আগ্রহ জাগতে লাগলোঃ হায়! আল্লাহর তরফ থেকে যদি কোনো অলৌকিক নিদর্শন প্রকাশ পেতো, যা দেখে অবিশ্বাসী লোকেরা ঈমান আনতো এবং ইসলামের সত্যতা স্বীকার করতো। কিন্তু তাঁদের আগ্রহের জবাবে বলা হচ্ছিলোঃ “অধৈর্য হয়ো না। যে ধারা ও নিয়মে আমি আন্দোলন পরিচালিত করছি, ঠিক সেভাবে ধৈর্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে তুমি কাজ করতে থাকো। মু‘জিজার দ্বারা কাজ হাসিল করতে চাইলে তা অনেক আগেই সম্পন্ন হয়ে যেতো। আমি যদি ইচ্ছা করতাম তো এক-একটি কাফিরের অন্তর মোমের মতো নরম করে দিতাম এবং তাদেরকে জোরপূর্বক সুপথে চালিত করতাম। কিন্তু এটা আমার নীতি নয়। এভাবে না মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও ক্ষমতার কোনো পরীক্ষা হয়ে থাকে, আর না তার চিন্তাধারা ও নৈতিক জীবনে আদর্শ সমাজ গড়ার উপযোগী কোনো বিপ্লব আসতে পারে। কাজেই তোমাকে লোকদের বেপরোয়া আচরণ এবং তাদের অবিশ্বাসকে ধৈর্যের সঙ্গে মুকাবিলা করতে হবে। তার মানে এই নয় যে তাঁকে কোন মু‘জিজাই দেয়া হয়নি। তাঁর সবচেয়ে বড় মু‘জিজা হলো আল্ কুরআন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে তাঁর ব্যক্তিসত্তা থেকে অসংখ্য মু‘জিজা প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ এবং তাঁর মহাকাশ ভ্রমণ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এতদভিন্ন বহুতর ভবিষ্যদ্বাণীর সফল হওয়া, তাঁর দোয়ার ফলে পানি বর্ষিত হওয়া, লোকদের সুপথপ্রাপ্ত হওয়া, প্রয়োজনের সময় অল্প জিনিস বৃদ্ধি পাওয়া, রুগ্ন ব্যক্তির আরোগ্য লাভ করা, পানি প্রবাহিত হওয়া ইত্যাকার অসংখ্য মু‘জিজা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে।
শান্তি প্রতিষ্ঠার ১৪ দফা :
১। আল্লাহর আইনের আনুগত্য করা। মানব রচিত মতবাদ দিয়ে মানুষের জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা সুদুর পরাহত। তাই মানুষের সামগ্রিক জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ প্রদত্ত আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। ২। পারিবারিক জীবনে শান্তি, শৃঙ্খলার জন্য পিতা-মাতার সাথে ভাল আচরণ করা। ৩। সামাজিক বন্ধন মজবুত করার জন্য আত্মীয় স্বজনের সাথে ভাল আচরণ করা, তাদের হক এবং মিসকীন ও পথিক (মুসাফির) দের হক আদায় করা। ৪। অপচয় না করা। আল্লাহ বলেন তোমরা অপচয় করো না। অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয় খরচ এবং আত্মীয় স্বজনের ফকির-মিসকীনের হক আদায় না করে বিভিন্ন খাতে প্রচুর টাকা অপচয় করি। ৫। আয়-ব্যয় ভারসাম্য রাখতে হবে। ভারসাম্যহীন জীবন মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসে তাই আয় এবং ব্যয়ের সাথে সংগতি রেখে খরচ করতে হবে। বেহিসাবী খরচ যেমন করা যাবে না তেমনি আবার কৃপন ও হওয়া যাবে না। ৬। রিযিক বন্টনের ব্যাপারে আল্লাহর যে নীতি কাউকে বেশী আবার কাউকে কম দিয়েছেন। তা মেনে নেওয়া। এ নীতি অত্যন্ত যুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক এবং এ নীতি ধনী গরীব সকলের জন্য কল্যাণকর। ৭। নিজ সন্তান হত্যা না করা। আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা গরীব হয়ে যাওয়ার ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করো না। তাদের ও তোমাদের রিযিক আমি দেবো’। খাওয়া-পরার ভয়ে নিজ সন্তানকে হত্যা করা বড় ধরনের অপরাধ। আমাদের উচিত সন্তানদের বেঁচে থাকার অধিকার দিয়ে তাদেরকে সুশিক্ষিত করে সম্পদে পরিণত করা। ৮। জ্বেনা ব্যাভিচার ও অশ্লীলতা রোধ করা। জ্বেনা ব্যাভিচার ও অশ্লীলতা সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জন্য এক ভয়ংকর মহামারী। অশ্লিলতার কারণে নৈতিক ও চরিত্রহীন যে সমাজ গঠিত হয় তা জাতির জন্য অভিশাপ। ৯। বিনা বিচারে কাউকে হত্যা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন- ‘জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তোমরা এই আদেশ মেনে চলবে যে কাউকে হত্যা করবে না’। কারণ মানুষের জীবন আল্লাহর নিকট অতি পবিত্র। তাই মানুষ হত্যা তিনি হারাম করেছেন। এ আদেশের মধ্যে গুপ্ত হত্যা, বিনা বিচারে হত্যাসহ সকল প্রকার খুন, গুম ও অপহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১০। ইয়াতিমের সম্পদ সংরক্ষণ করা।  মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘তোমরা কখন এতিমের মাল স্পর্শ করো না’। কিন্তু এতিম যতক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞন বুদ্ধি সম্পন্ন হওয়ার মত বয়সে না পৌঁছে ততদিন পর্যন্ত তার সম্পত্তি দেখাশুনা করা উত্তম। ১১। ওয়াদা, চুক্তি ও অংগীকার পালন করা, ওয়াদা বা চুক্তি বা ব্যক্তিগত হোক বা রাষ্ট্রীয় অথবা আন্তর্জাতিক যে পর্যায়ের হোক যে কোন চুক্তি তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ১২।ইনসাফভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা। বর্তমান অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থায় ইনসাফভিত্তিক বিলি বন্টন না থাকার কারণে অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে। একদল লুটেরা ও আরেক দল বঞ্চিত থেকেই যাচ্ছে। ১৩। অনুমানভিত্তিক কোন কাজ করবে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিত মনগড়া অনুমান নির্ভর না হয়ে শ্রবণ শক্তি, দৃষ্টি শক্তি ও চিন্তা শক্তিসহ প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে সিদ্ধান্তে উপনীত হলে বিপদগামী বা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। ১৪। অহংকার পরিহার করা। আল্লাহ বলেন- তোমরা জমিনের উপর দিয়ে কখনও গর্ব করে চলাফিরা করো না। তোমাদের গর্ব, অহংকার যমীন ভাঙতে পারবে না এবং পাহাড়ের সমান ও উঁচু হতে পারবে না। অহংকার আল্লাহর চাদর এটি শুধু তাঁর জন্য।  আল্লাহর বান্দার জন্য অহংকার শোভা পায়না। অতীতে অনেক জাতি, বড় স্বৈরাচারী শাসক গোষ্ঠী, গর্ব অহংকার করে ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই আমাদের উচিত গর্ব, অহংকার, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করা। আধুনিক পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র যদি এসব ধারাগুলোকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যকর করা হয় তাহলে আর কি এমন কোন চোরা পথ খোলা থাকে যে পথ ধরে সমাজে অশান্তি ঢুকতে পারে?
বিদায়, হে মক্কা! (হিজরত)

অস্থিতিশীল নিমজ্জমান সমাজ ব্যবস্থার শেষ অস্ত্র হয়ে থাকে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও নির্যাতন নিপীড়ন। এতেও যদি প্রতিপক্ষকে দমন করা সম্ভব না হয়, তাহলে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিরোধীরা শান্তি আন্দোলনের মূল ব্যক্তিকে হত্যা করতে সিদ্ধান্ত নেয়। মক্কবাসীতো আগে থেকেই আক্রোশে অধীর ছিল কিভাবে মুহাম্মাদ সা.কে নির্মূল করা যায়। কিন্তু পেরে ওঠেনি। এবার চরম মূহুর্ত উপস্থিত। ইসলামী আন্দোলনের মূল ব্যক্তিসহ সাথীদের জন্য মক্কা জ্বলন্ত আগুনের রূপ ধারণ করল। কোরায়েশ নরপশুরা তাদের যুলুমের ষ্টীম রোলার চালিয়ে সত্যের নিশানাবাহীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুললো। রাসূল সা. এর রক্তপিপাসু দুশমনেরা তাঁর বিরুদ্ধে এক ভয়ংকর চক্রান্তের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে গেলো। এই কঠিন পরিস্থিতে মি‘রাজ থেকে এসে রাসূল সা. উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিলেন। আভাসে ইংগিতে তিনি হিজরতের পথ উন্মুক্ত হওয়ার ও তারপর ক্ষমতার যুগ শুরু হওয়ার আশ্বাস দিলেন। এই শুভ সংবাদের ফলে মুসলমানদের মধ্যে নতুন আশা ও উদ্দীপনা সৃষ্টি হলো। যারা সহিংসতার স্বীকার হয়েছিল, তারা সান্ত্বনা পেল এবং তাদের ও উৎসাহ বৃদ্ধি পেল। এছাড়াও আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর বাণীর মাধ্যমে হিজরতের জন্য বার বার ইশারা দিতে লাগলেন। “হে আমার বান্দাগণ ! তোমরা শুধু আমারই ইবাদত করতে থাকো। আমার ইবাদতের কারণে যদি স্বদেশের জমিন তোমাদের জন্যে সংকীর্ণ হয়ে যায় তাহলে সেজন্যে কোনো পরোয়া করোনা; আমার জমিন অত্যন্ত প্রশস্ত।” (সূরা আন্কাবুত-৫৬) অর্থাৎ এজন্যে যদি ঘরবাড়ীও ছেড়ে দিতে হয় তো তাই কর; কিন্তু আমার বন্দেগীর সম্পর্ক ছিন্ন করো না। হিজরত শব্দের শাব্দিক অর্থ ত্যাগ করা, বর্জন করা। মনের অসন্তষ্টি চিত্তে কোন কিছু ত্যাগ করা। ইসলামী পরিভাষায় ঃ দীন-ইসলামের জন্যে নিজের দেশ ছেড়ে এমন স্থানে গমন করা যেখানে দীনের প্রয়োজন সমূহ পূর্ণ হতে পারে। কারণ ইসলামী ধারায় জীবন-যাপন করার এবং আল্লাহর দীনের দিকে আহবান জানানোর আজাদী যে দেশে নেই, সে দেশকে শুধু আয়-উপার্জন, ঘর-বাড়ী, ধন-সম্পত্তি কিংবা আত্মীয়-স্বজনের মায়ায় আঁকড়ে থাকা মুসলমানের পক্ষে জায়েজ নয়। মনে রাখতে হবে যে,কুফরী রাষ্ট্র বলতে শুধু কাফির, মুশরিক ও নাস্তিকদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রকেই বুঝায়না, বরং এমন প্রত্যেক রাষ্ট্রকে বুঝায়, যে সকল রাষ্ট্রে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ বলে বিশ্বাস করে, সে সকল রাষ্ট্রের অধিবাসী বা শাসকবৃন্দ ‘মুসলিম’ নামে পরিচিত হলের কার্যত তাতে কিছু আসে যায় না। আল্লাহর দীনের প্রতি ঈমান পোষণকারীর পক্ষে কোন কুফরী ব্যবস্থার অধীনে জীবন-যাপন করা কেবল দু‘টি অবস্থায় সংগত হতে পারে। একঃ সংশ্লিষ্ট দেশে ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং কুফরী ব্যবস্থাকে ইসলামী ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করার জন্যে সে ক্রমাগত চেষ্টা-সাধনা করতে থাকবে। যেমন, এযাবত মক্কায় থেকে মুসলমানরা যেরূপ চেষ্টা-সাধনা করে আসছিলো এবং এর জন্যে সর্বপ্রকার দুঃখ-কষ্ট সহ্য করছিলো। দুইঃ সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে বেরোবার কোনো পথ যদি সত্যিই না থাকে কিংবা ইসলামী ধারায় জীবন-যাপন ও ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত চেষ্টা-সাধনা করার উপযোগী কোন জায়গা যদি সে খুঁজে না পায়। কিন্তু দীনের প্রয়োজন পূর্ণ হবার উপযোগী জায়গা যখনি পাওয়া যাবে-মদীনা থেকে যেমন প্রত্যাশা করা গিয়েছিলো- তখন অবশ্যই তাদের হিজরত করে সেখানে চলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, হিজরতের জন্যে কোনো দারুল ইসলাম বর্তমান থাকা অপরিহর্য নয়। মুসলমানগণ প্রয়োজন হলে যে কোনো পাহাড়-জংগলে জীবন যাপন করতে পারে,কিন্তু তাদের পক্ষে কুফরী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নিঃশ্চিন্তে আনুগত্য করা চলবেনা। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে মুসলমানদের নিকট যে কোন জিনিসের চেয়ে তার দীনের মর্যাদা রক্ষার গুরুত্ব অনে বেশী। তবে এক্ষেত্রে যারা নিতান্তই অক্ষম ও পংগু এবং যারা অসুস্থতা কিংবা দারিদ্র্যের কারণে কোনো প্রকারেই হিজরতের জন্যে সফর করতে সক্ষম নয়, কেবল তারাই ক্ষমা পাবার যোগ্য।
সাধারণ মুসলমানদের হিজরত

আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় শপথের পর থেকেই মদীনায় ইসলামের অগ্রগতি হচ্ছিলো। শুধু অগ্রগতিই নয়, যে কোন পরিস্থিতিতে তারা মুসলমানদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দানের ব্যাপারেও অংগীকারাবদ্ধ হয়েছিলো। মক্কায় মুসলমানদের কঠিন পরিস্থিতির সময় নির্যাতিত মুসলমানদেরকে রাসূল সা. মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। এটা টের পেয়েই কুরাইশরা মুসলমানদেরকে বিরত রাখার জন্যে জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো এবং মুসলমানরা যাতে তাদের নাগাল থেকে বেড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্যে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মুসলমানরা তাদের ধন-প্রাণ ও সন্তা-সন্ততির জীবন বিপন্ন করেও নিছক দীনের খাতিরে দেশত্যাগ করাকেই পছন্দ করলো। কোনো প্রলোভন বা ভয়-ভীতিই তাদেরকে বিরত রাখতে পারলো না। একের পর এক সাহাবীগণ মদীনায় চলে যেতে লাগলেন। রাসূল সা.এর সংগে থেকে গেলেন হযরত আবু বকর ও আলী (রা:)। আর কিছু সাহাবী থেকে গেলেন যারা দারিদ্র ও শারীরিক অক্ষমতার কারণে হিজরত করতে অসমর্থ ছিলেন। মহল্লার পর মহল্লা খালি হয়ে গেল। একবার আবু জাহল সহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কুরাইশ নেতারা বনু জাহশ গোত্রের শূন্য বাড়ীঘর দেখে বলতে লাগলোঃ ‘এটা আমাদেও ভাতিজা (মুহাম্মাদ)এর কীর্তি। সে আমাদের ঐক্য ভেঙ্গে দিয়েছে’। সাথীদের মদীনা চলে যাওয়া সত্বেও রাসূল সা. নিজ দাওয়াতের কেন্দ্র ভূমি ত্যাগ করেননী। তিনি আল্লাহর অনুমতির অপেক্ষায় রয়ে গেলেন।

সাধারণ মুসলমানদের হিজরত
আকাবার প্রথম ও দ্বিতীয় শপথের পর থেকেই মদীনায় ইসলামের অগ্রগতি হচ্ছিলো। শুধু অগ্রগতিই নয়, যে কোন পরিস্থিতিতে তারা মুসলমানদের সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দানের ব্যাপারেও অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলো। মক্কায় মুসলমানদের কঠিন পরিস্থিতির সময় নির্যাতিত মুসলমানদেরকে রাসূল সা. মদীনায় হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। এটা টের পেয়েই কুরাইশরা মুসলমানদেরকে বিরত রাখার জন্যে জুলুমের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিলো এবং মুসলমানরা যাতে তাদের নাগাল থেকে বেড়িয়ে যেতে না পারে, সেজন্যে সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু মুসলমানরা তাদের ধন-প্রাণ ও সন্তান-সন্ততির জীবন বিপন্ন করেও নিছক দ্বীনের খাতিরে দেশত্যাগ করাকেই পছন্দ করলো। কোনো প্রলোভন বা ভয়-ভীতিই তাদেরকে বিরত রাখতে পারলো না। একের পর এক সাহাবীগণ মদীনায় চলে যেতে লাগলেন। রাসূল সা.এর সঙ্গে থেকে গেলেন হযরত আবু বকর ও আলী (রা:)। আর কিছু সাহাবী থেকে গেলেন যারা দারিদ্র ও শারীরিক অক্ষমতার কারণে হিজরত করতে অসমর্থ ছিলেন। মহল্লার পর মহল্লা খালি হয়ে গেল। একবার আবু জাহলসহ অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় কুরাইশ নেতারা বনু জাহশ গোত্রের শূন্য বাড়ি-ঘর দেখে বলতে লাগলোঃ ‘এটা আমাদের ভাতিজা (মুহাম্মাদ)এর কীর্তি। সে আমাদের ঐক্য ভেঙ্গে দিয়েছে। আমাদের সমাজকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছে। আমাদের পরস্পরের মধ্যে ভাংগন লাগিয়ে দিয়েছে।’ সাথীদের মদীনা চলে যাওয়া সত্ত্বেও রাসূল সা. নিজ দাওয়াতের কেন্দ্রভূমি ত্যাগ করেন নি। তিনি আল্লাহর অনুমতির অপেক্ষায় রয়ে গেলেন। কুরাইশরা যাদের আটক রেখেছিল কিংবা ভয়ভীতি দেখিয়ে যেতে বাঁধা দিয়েছিল, এমন স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তি ছাড়া তেমন কোন মুসলমান আর মক্কায় অবশিষ্ট্য ছিলনা। তবে ঘনিষ্ট সাথীদের মধ্যে হযরত আবু বকর ও হযরত আলী (রা:) তখনো মক্কায় ছিলেন।


মুহাম্মাদ (সা.)কে হত্যা করার সলা-পরামর্শ
সাহাবীগণ হিজরত করে মদীনায় চলে যাওয়ার পর রাসূল (সা.) হিজরতের ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় মক্কায় রয়ে গেলেন। কুরাইশরা চিন্তায় পড়ে গেল এই ভেবে যে, মুসলমানগণ একে একে সবাই মদীনায় গিয়ে শক্তি সঞ্চার করছে এবং সেখানে ইসলাম ক্রমশঃ প্রসার লাভ করছে। তাই তারা রাসূল (সা.)-এর দেশত্যাগের ব্যাপারে আসন্ন জাতীয় দুর্যোগ মনে করে এর থেকে উত্তরণের পন্থা বের করার জন্যে ‘দারুন-নাদওয়ায়’ পরামর্শ সভার আয়োজন করলো। এই গৃহটি ছিলো কুসাই ইবনে কিলাবের বাড়ি। মক্কার মুশরিক কুরাইশরা যে কোন জাতীয় সমস্যাবলী সম্পর্কে আলোচনার জন্য এখানে সমবেত হত। এবার তারা রাসূল (সা.)-এর ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য নির্ধারিত দিনে সেখানে সমবেত হওয়ার জন্য আহবান করলো। এই দিনকে তারা ‘গণসমাবেশ দিবস’ নামে অভিহিত করলো। তাদের পরামর্শ গৃহে প্রবেশ পথে ইবলিস শয়তান কম্বল জড়িয়ে এক বৃদ্ধের বেশে দাঁড়ালো। তাকে দেখে সবাই বললো, “এই বৃদ্ধলোকটি কে?” সে বললো, “আমি নাজদের অধিবাসী। তোমরা যে উপলক্ষে আজ সমবেত হয়েছো, তা আমি শুনেছি। তাই তোমাদের কথাবার্তা শোনার জন্য এসেছি। আশা করি আমার উপদেশ ও তোমাদের কাজে লাগতে পারে।” একথা শুনে সবাই তাকে পরম সমাদরে ও শ্রদ্ধার সঙ্গে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দিলো। সে সবার সাথে প্রবেশ করলো। ততক্ষণে কুরাইশদের বড় বড় নেতারা ভেতরে আসন গ্রহণ করেছে। অতঃপর রাসূল (সা.) সম্পর্কে তারা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো, “এই লোকটির তৎপরতা বর্তমানে কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তোমরা সবাই তা জান। সে তার বাইরের অনুসারীদের নিয়ে কখন যে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার কোন ঠিক নেই। তার আক্রমণ থেকে আমরা এখন নিরাপদ নই। অতএব,সবাই মিলে তার ব্যাপারে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর।” সলা পরামর্শ চলতে থাকলো। একজন বললো, “তাঁকে কোন লোহার তৈরী হাজতখানায় আটক করে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে দরজা বন্ধ করে রাখা হোক। এতে আপত্তি তুলে বলা হলো যে, সে এমন এক ব্যক্তি, যার কথা বদ্ধ লোহার ঘর থেকেও বাইরে চলে যাবে, আর তাঁর সাথীরা শক্তি অর্জন করলে তাঁকে বের করে নিয়ে যাবে। অন্য কোন উপায় খুঁজতে হবে।” শয়তান এ কথায় সমর্থন দিলে কণ্ঠ ভোটে এ প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। মজলিসে জনৈক সদস্য প্রস্তাব দিল, ‘তাঁকে মক্কা থেকে বের করে দেয়া হোক।’ এ প্রস্তাবে আপত্তি তুলে বলা হলো, মুহাম্মাদ যেখানেই যাবে সেখানেই তাঁর আকর্ষণীয় কথাবার্তায় তাঁর পক্ষে জনমনে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার প্রভাব ঘটবে এবং ইসলামী আন্দোলন সামনে অগ্রসর হবে, এ আশঙ্কায় উক্ত প্রস্তাবও নাকচ করা হলো। অবশেষে আবু জেহেল প্রস্তাব উত্থাপন করলোঃ “প্রত্যেক গোত্র থেকে একজন করে শক্তিশালী ও প্রতাপশালী যুবককে বেছে নিয়ে তাদের সবার হাতে তলোয়ার দিতে হবে; এরা সবাই এক সাথে মুহাম্মাদের উপর হামলা করবে এবং তাঁকে হত্যা করে ফেলবে। এভাবেই আমরা তাঁর ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পেতে পারি। এতে মুহাম্মাদের খুনের দায়দায়িত্ব ও রক্তপণ সকল গোত্রের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। বনু হাশিম গোত্র একাকী সব গোত্রের ওপর প্রতিশোধ নিতে সাহস করবে না। রক্তপণ নিয়ে তারা সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হবে। আমরা সকল গোত্র মিলে তাদেরকে রক্তপণ দিয়ে দেব।”শয়তান বললো, “এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। আমি মনে করি এর চেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত আর হতে পারে না।”শয়তানের সমর্থনের পর এ অভিমতটি সবাই পছন্দ করলো, এবং এ কাজের জন্যে একটি রাতও নির্দিষ্ট করা হলো। নয়টি গোত্র থেকে বাঁছাই করে এগারোজন যুবককে এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দিষ্ট রাতে মনোনীত ব্যক্তিগণ মুহাম্মাদ (সা.)-এর বাসভবন ঘেরাও করে থাকবে। ভোরে তিনি যখন বাইরে বেরোবেন, তখন তারা আপন কর্তব্য সমাধা করবে। এরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ এই যে, আরবরা রাতের বেলায় অন্য কারো ঘরে প্রবেশ করাকে পছন্দ করতো না। তারা ষড়যন্ত্র করতে থাকলো আর আল্লাহ পাকও কৌশল করতে থাকলেন। আল্লাহ তা‘য়ালা দুশমনদের এই গোপন দূরভীসন্ধির কথা রাসূল (সা.)-কে অবহিত করতে থাকলেন। হিজরতের দু‘দিন আগে থেকেই তিনি হযরত আবুবকর (রা.)-এর সাথে পরামর্শ করেন যে তিনিও তাঁর সাথী হচ্ছেন। সফরের জন্যে দু‘টি উষ্ট্রী প্রস্তুত করা হলো এবং কিছু পাথেয় তৈরী করে নেয়া হলো।
অতঃপর সেই প্রতীক্ষিত সময়টি এলো, যখন তিনি মক্কা ছেড়ে মদীনায় গমন করার জন্যে ওহীযোগে নির্দেশ পেলেন। জিব্রিল (আ:)এসে মুহাম্মাদ সা.কে বললেন, “আপনি প্রতিদিন যে বিছানায় ঘুমান আজ রাতে সে বিছানায় ঘুমাবেন না।” রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে নির্ধারিত ঘাতকের দল রাসূল সা.এর ঘরের দরজায় এসে সমবেত হয়ে ওঁত পেতে থাকলো। তিনি কখন ঘুমান তারা তার প্রতীক্ষা করতে লাগলো। রাসূল সা.তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে তিনি আলী (রা:)কে ডেকে বললেনঃ “আমি হিজরতের নির্দেশ পেয়েছি এবং আজ রাতেই মদীনা রওয়ানা হয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে বহু লোকের আমানত জমা রয়েছে। সকালে তুমি এগুলো লোকদের নিকট ফেরত দিও। আজ রাতে তুমি আমার বিছানায় ঘুমাও,যেন আমি ঘরে আছি ভেবে লোকেরা নিশ্চিন্ত থাকে।”এত উঁচু মানের নৈতিকতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর আছে কি যে, যারা তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে আর সে হত্যাকারীদের আমানত ফেরত দেয়ার চিন্তায় বিভোর? কুরাইশরা ইসলাম বৈরিতার কারণে মুহাম্মাদ সা.এর রক্তের নেশায় উম্মাদ হয়ে উঠেছিলো; কিন্তু এ অবস্থায়ও তারা মুহাম্মাদ সা.কে শ্রেষ্ঠ আমানতদার ও বিশ্বাসভাজন বলে মনে করে তাদের ধন-সম্পদ রাসূল সা.এর নিকট জমা রাখতো। ঘাতক দল বাড়ি ঘেরাও করে অপেক্ষায় প্রহর গুনছে আর তাদের ভিতর দিয়েই তিনি বেরিয়ে এসে সোজা আবু বকর রা.এর বাড়ী এসে হাজির হলেন। আসমা বিনতে আবু বকর দ্রুত নিজের কোমরের বেল্ট কেটে দুটো বানালেন এবংএকটি দিয়ে খাবারের পুটুলি ও অপরটা দিয়ে পানির মসকের মুখ বাঁধলেন। সত্যের পথের এই দুই অভিযাত্রী রাতের আঁধারে রওয়ানা হলেন। আজ বিশ্বমানবতার সবচেয়ে বড় উপকারী ও শুভাকাংখী, মানুষের পরীক্ষিত বন্ধু অতি আপন জন মুহাম্মাদ সা.একেবারেই বিনা অপরাধে ঘরবাড়ী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। আজ তিনি সেই সব অলিগলিকে বিদায় জানাতে জানাতে যাত্রা করছেন, যেখানে চলাফেরা করে তিনি বড় হয়েছেন,যার ওপর দিয়ে তিনি সত্যের বাণী সমুন্নত করতে হাজার হাজার বার দাওয়াতী সফর করেছেন, যেখানে তিনি অসংখ্য গালাগাল খেয়েছেন এবং নির্যাতন সয়েছেন। আজ তাঁর হারাম শরীফের পবিত্র আধ্যাত্মিক কেন্দ্র থেকে বিদায় নেয়ার পালা, যেখানে তিনি বহুবার সিজদা করেছেন, বহুবার আপন জাতির কল্যাণ ও সুখশান্তির জন্য দোয়া করেছেন, বহুবার কুরআন পড়েছেন, বহুবার এই চত্তরে নিরাপত্তার গ্যারান্টিযুক্ত এই একমাত্র আশ্রয়স্থলেও বিরোধীদের হাতে নিপীড়িত হয়েছেন। শুনতে হয়েছে মর্মঘাতী বোলচাল। যে শহরের আকাশ বাতাস আজও তাঁর দোয়ায় মুখরিত, সেই শহরকে আজ তাঁর শেষ সালাম নিবেদন করতে হচ্ছে। এটা করতে গিয়ে তাঁর হৃদয় যে বিদীর্ণ হয়ে গেছে, কলিজা যে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, চোখে যে অশ্রুর বান ডেকেছে, সেটাইতো স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও জীবনের লক্ষ্য অর্জনে যেহেতু এ কুরবানীর প্রয়োজন ছিল, তাই শ্রেষ্ঠ মানব এ কুরবানী দিতেও দ্বিধা করলেন না। সত্যের দাওয়াতের চারা গাছটি মক্কার মাটিতেই জন্মেছিল। কিন্তু তার ফল আহরণ করার সৌভাগ্য মক্কাবাসীর কপালে জোটেনী সত্যের বিরোধীতার কারণে। এ সৌভাগ্য অর্জন করলো মদীনাবাসী এবং সেই সাথে সারা দুনিয়াবাসী যারা তাঁর আদর্শ কবুল করে তা বাস্তবায়নে সর্বাত্মক চেষ্টা করলো। অথচ ঐ লোকগুলোই নিজেদেরকে বড় মনে করতো, অভিজাত ও কুলীন মনে করতো, আর নিম্ন মনে করা হতো তাদেরকে। আল্লাহ পাক তাদের জন্যই বরাদ্দ করলেন উচ্চুতর ও শ্রেষ্ঠত্বের আসন দুনিয়া ও আখেরাতের জন্যে। রাসূল সা. শেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মক্কাকে বললেনঃ “ আল্লাহর কসম, তুমি আল্লাহর সর্বোত্তম ভূখন্ড এবং আল্লাহর দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা প্রিয় ভূখন্ড। আমাকে এখান থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেয়া না হলে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতামনা।” কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সূর পর্বত গুহায় উপনীত হলেন।
কোন পথ ধরে যেতে হবে, সেটা স্বয়ং রাসূল সা.নির্ধারণ করলেন। আব্দুল্লাহ বিন আরিকতকে নির্দিষ্ট মজুরীর ভিত্তিতে পথ প্রদর্শক নিয়োগও তিনিই করলেন। আবু বকরের ছেলে আব্দুল্লাহ রাতে মক্কার সমস্ত সংবাদ পৌঁছাতেন। আমের বিন ফুহাইরা (আবু বকরের ক্রীতদাস) মেষপাল নিয়ে সারাদিন গুহার আশপাশ দিয়ে চরিয়ে বেড়াতো আর সন্ধা হলে গুহার কাছে নিয়ে যেত, যাতে উভয়কে প্রয়োজনীয় দুধ সরবরাহ করতে পারেন। তিনি তিন দিন গুহায় কাটালেন।
এদিকে কুরাইশগণ সারা রাত রাসূল সা.এর বাড়ী ঘেরাও করে রাখলো। তাছাড়া পুরো শহরের সীমানাও বন্ধ করে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু যখন জানতে পারলো যে, তাদের সেই কাংখিত ব্যক্তিটিই হাতছাড়া হয়ে গেছে,তখন তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। রাসূল সা.এর বিছানায় আলী রা: কে দেখে তারা গভীর হতাশায় ভেংগে পড়লো। চারিদিকে তালাশ করতে লোক পাঠানো হলো। একটা দল অনেক দোঁড়ঝাপ করে সূর পর্বতগুহায় এসে হাজির হলো। ভেতর থেকে তাদের পা দেখা যাচ্ছিলো। কী সাংঘাতিক নাজুক মুহূর্ত ছিল তখন তা, ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। আবু বকর এই ভেবে চিন্তিত হলেন যে,এরা গুহায় ঢুকে পড়লে রাসূল সা. এর জীবন ও গোটা ইসলামী আন্দোলন হুমকীর সম্মুখীন হবে। তাঁর এই অস্থিরতা লক্ষ্য করে মুহাম্মাদ সা. অত্যন্ত প্রশান্ত চিত্তে বললেন,“ঘাবড়িও না,আল্লাহ আমাদের সাথে রয়েছেন।” কার্যত হলোও তাই। আল্লাহ তা‘য়ালার অনুগ্রহে গুহামুখে এমন কতিপয় নিদর্শন ফুটে উঠলো যে, তা দেখে কুরাইশরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। তাদের মনে ধরণা জন্মালো যে,এ গুহার ভিতরে কেউ প্রবেশ করেনি। তিন দিন পর রাসূল সা. আবু বকর ও পথ প্রদর্শক আমের বিন ফুহাইরাকে নিয়ে বেরিয়ে রওনা দিলেন। কুরাইশ গোয়েন্দারা যাতে তাদের পিছু নিতে না পারে, সে জন্য সাধারণ চলাচলেন পথ বাদ দিয়ে সমুদ্রোপকূলের দীর্ঘ পথ অবলম্বন করা হয়। এদিকে মক্কায় ঘোষণা করা হয় যে, মুহাম্মাদ সা. কে যদি কেউ জীবিত বা মৃত অবস্থায় গ্রেফতার করে এনে দিতে পারে, তাহলে তাকে একশত উট পুরস্কার দেয়া হবে। এই পুরস্কারের আশায় বহু লোক চারিদিকে বেড়িয়ে পড়লো রাসূল সা.এর সন্ধানে। সুরাকা বিন মালেক বিন জা‘সাম খবর পেল যে, এ ধরনের দু‘জনকে উপকূলীয় সড়কে দেখা গেছে। সে একটা বর্শ হাতে ঘোড়া হাঁকিয়ে রওনা হয়ে গেল। কাছাকাছি এসেই সুরাকা যখন ত্বরিত গতিতে ধাওয়া করলো, অমনি তার ঘোড়ার সামনের দু‘পা মাটিতে দেবে গেল। সুরাকা দু‘তিনবার ব্যর্থ চেষ্টা চালানোর পর ক্ষমা চাইল এবং একটা লিখিত নিরাপত্তানামাও চাইল। নিরাপত্তানামা লিখে দেয়া হলো। সে বুঝতে পারলো যে, এই ব্যক্তিদের মাধ্যমে এক নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে। এই সফর কালে বারিদা আসলামীও পুরস্কারের লোভে সত্তর জন সাথীসহ বেরিয়ে ছিলো। কিন্তু রাসূল সা.এর সামনে আসা মাত্রই বারিদার মধ্যে পরিবর্তন এল। যখন রাসূল সা.তাকে সুসংবাদ দিলেন যে, “তোমার অংশ নির্ধারিত হয়ে গেছে” (অর্থাৎ তুমিও ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে অবদান রাখবে এটা নির্ধারিত হয়ে গেছে)। তখন বারিদা সত্তর জন সাথীসহ ইসলাম গ্রহণ করলো। এরপর বারিদা বললো, ‘রাসূল সা. মদীনায় প্রবেশকালে তাঁর সামনে একটা পতাকা থাকা উচিত। রাসূল সা. সম্মতি দিলেন এবং নিজের পাগড়ি বর্শার মাথায় বেঁধে বারিদার হাতে সমর্পণ করলেন। এই পতাকা উড়িয়ে কাফেলা মদীনায় প্রবেশ করলো। “অবশ্যই তোমাদেরকে তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবনের ক্ষয়ক্ষয়তির দ্বারা পরীক্ষা করা হবে। আর আহলে কিতাব ও মোশরেক-উভয় গোষ্ঠির নিকট হতে তোমাদের অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনতে হবে। এ সব পরীক্ষায় তোমরা অবিচল থাকতে পারলে এবং (অসৎ কাজ থেকে) বিরত থাকলে নিঃসন্দেহে সেটা হবে বিরত্বের কাজ।”( আল ইমরান,১৮৬)।


নাম

আর্টিকেল,25,ডাউনলোড,1,বুখারী,81,মাসায়ালা,16,মুসলিম,54,
ltr
item
সহী আকীদা: রাসূল (স) এর মক্কী জীবন
রাসূল (স) এর মক্কী জীবন
সহী আকীদা
https://soheeaqida.blogspot.com/2018/08/blog-post_64.html
https://soheeaqida.blogspot.com/
http://soheeaqida.blogspot.com/
http://soheeaqida.blogspot.com/2018/08/blog-post_64.html
true
2725583972515071055
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS PREMIUM CONTENT IS LOCKED STEP 1: Share to a social network STEP 2: Click the link on your social network Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy